প্রশ্নবিদ্ধ বিরোধী দলের উপস্থিতিই সাফল্য?

নানা বিতর্ক নিয়ে যাত্রা শুরু করা দশম জাতীয় সংসদের এক বছর পূর্ণ হল বৃহস্পতিবার।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2015, 06:50 PM
Updated : 29 Jan 2015, 06:55 PM

বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর ২৯ জানুয়ারি শুরু হয় দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন। 

এই প্রথম সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা দলকে মন্ত্রিসভায়ও দেখেছে বাংলাদেশ। দলটি হল গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি।  

নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভা ছাড়ব-ছাড়ব করার মধ্য দিয়েই এক বছর পার করেছে।

আর সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী ঘটনার জন্ম দিয়েছে জাতীয় পার্টি, ’৯০ এর থেকে প্রতিটি সংসদে সরকার অথবা বিরোধী দলে থাকা বিএনপি যাদের বলে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’।  

দলটির বিভিন্নমুখী এই ভূমিকা নিয়ে দশম সংসদের এক বছরকালে মূল্যায়ন করতে বলা হলে সংসদীয় রাজনীতির গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ সরাসরিই বলেন, “এ সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।”

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি যেমন সরকারের অংশ, জাতীয় পার্টিও তাই। জাতীয় পার্টি যদি বিরোধী দল হয়, তাহলে ওয়ার্কার্স পার্টি আর জাসদ কেন বিরোধী দল নয়?”

সংসদ শুরুর প্রথম দিনই জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু বিরোধী দলের পরিচয় নিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে সবসময়ই ভুগতে দেখা গেছে এরশাদের দলটিকে, যিনি নিজেও হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

সংসদের চারটি অধিবেশনেই জাতীয় পার্টির কোনো না কোন নেতাকে অধিবেশন কক্ষে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে, কেন তারা বিরোধী দল; যদিও সংসদের মধ্যে তাদের অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। 

এই অবস্থায় নিজেদের অবস্থানের মূল্যায়ন জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী উপস্থিতির ওপরই গুরুত্ব দেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি প্রমাণ করে সংসদ কার্যকর। এখন পর্যন্ত বিরোধী দল এক দিনের জন্যও সংসদ বর্জন করেনি।”

সংসদ অধিবেশনে বিরোধী দল

বিদ্যুৎ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খাদ্যে ভেজালসহ অনেক বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন দাবি করে জাতীয় পার্টির এই নেতা বলেন, “আমাদের অনেক সংসদ সদস্য নতুন, তবে আশা করছি, আগামী বছর আমরা আরও ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারব।”

তাজুল একথা বললেও সংসদের বছর পূর্তির দিন দলীয় এক কর্মসূচিতে তার দলের চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, “১৯৯১ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সংসদই কার্যকর হয়নি।”

বিগত নবম জাতীয় সংসদে মোট কার্যদিবস ছিল ৪১৮টি, যা বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে রেকর্ড।

অন্য যে কোনো সংসদের চেয়ে ওই সংসদে বিরোধী দলের বর্জনও ছিল রেকর্ড পরিমাণ। ওই সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত ছিল ৩৪২ কার্যদিবস, উপস্থিত ছিল ৭৬ কার্যদিবস। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন ১০ দিন।

সংসদের এক বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়নে এবার বিরোধী দলের বর্জন না থাকাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজও।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সংসদে কোনো অশালীন বক্তব্য হয় নাই, কটূক্তি হয় নাই। বিরোধী দল গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে, যা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে।”

বিরোধী দল এখনও উপনেতাহীন

এক বছর পার করে ফেললেও এখনও বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি।

উপনেতা মনোনয়ন নিয়ে দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের ‘দ্বন্দ্ব’ চলতি বছরে সংসদে বেশ আলোচনায় ছিল।

গত সেপ্টেম্বর মাসে কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করা-না করা নিয়ে দুজনই স্পিকারকে পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসেনি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছ থেকে।

কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ দিতে জাতীয় পার্টি অধিবেশনগুলোর বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমালোচনাও করেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে একবার ওয়াকআউটও করেছে দলটি।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী

সংসদের বাইরে বিএনপি এবং জ্যেষ্ঠ আইজীবীদের বিরোধিতার মধ্যে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল। 

বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে ‘অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরে গেল। স্বাধীনতার পর চার বছর পর্যন্ত এই ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতেই ছিল।

সংসদের হাতে এই ক্ষমতা রাখার বিরোধিতা করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। বিএনপি বলেছে, সরকারের ক্ষমতা একচ্ছত্র করতেই ওই আইন।

বিলটি পাসের আগে এর বিরোধিতার কথা বললেও প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি শেষ পর্য‌ন্ত এর পক্ষেই অবস্থান নেয়।

এক নজরে ১ বছর

দশম সংসদে এখন পর্যন্ত ৮৩ কার্যদিবসে বিল পাস হয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ সালের বাজেট সংক্রান্ত এবং সংবিধান সংশোধনের বিলও রয়েছে।

মোট ৮৩ কার্য দিবসের মধ্যে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৭৪ দিন এবং বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন ৩৬ দিন।

এই সংসদে এখন পর্য‌ন্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৭০৮টি প্রশ্ন করেছেন সংসদ সদস্যরা। শেখ হাসিনা উত্তর দিয়েছেন ১৭৩টি প্রশ্নের।

অন্যান্য মন্ত্রীদের কাছে প্রশ্ন ছিল ১১ হাজারেরও বেশি, যার বেশিরভাগের উত্তর দিয়েছেন তারা।

গত নবম সংসদের মত এই সংসদেও প্রথম অধিবেশনেই সব কটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়।

ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০টি সংসদীয় কমিটির ২৯৭টি বৈঠক হয়েছে। এরমধ্যে সর্বাধিক ১৬টি বৈঠক করেছে সরকারি হিসাব কমিটি। আগের সংসদের মতো এবারও এই কমিটি অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এছাড়াও সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ১১টি বৈঠক করেছে।

মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ১০টি বৈঠক করেছে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং নয়টি করে বৈঠক করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক-গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

সবচেয়ে কম তিনটি বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। চারটি করে বৈঠক করেছে স্থানীয় সরকার, পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি।

একটিও বৈঠক করেনি পিটিশন কমিটি, বিশেষ অধিকার, কার্যপ্রণালীবিধি ও বেসরকারি সদস্যদের বিল সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

এবারের সংসদের অন্যতম আলোচিত বিষয় কয়েকটি কমিটির বৈঠকে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি। এ নিয়ে কমিটির বৈঠকে সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সংসদ সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির আটটি বৈঠকের মধ্যে মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন চারদিন। শিল্প মন্ত্রণালয় কমিটির ছয়টি বৈঠকের মধ্যে মন্ত্রী আমির হোসেন আমু উপস্থিত ছিলেন তিনদিন।

এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী ছয়টি বৈঠকের মধ্যে তিনদিন এবং মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান আটটি করে বৈঠকের মধ্যে তিনদিন করে অনুপস্থিত ছিলেন।