সরকারের উদাসীনতায় বিপর্যয়ে সুন্দবরন: বিএনপি

শেলা নদীতে ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সরকারের উদাসীনতা ও অপরাজনীতিকে দায়ী করেছে বিএনপির গঠিত তদন্ত কমিটি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2014, 11:35 AM
Updated : 27 Dec 2014, 00:53 AM

এতে সুন্দরবন ‘দীর্ঘস্থায়ীভাবে মারাত্মক ক্ষতি’র মুখে পড়বে বলে আশঙ্কাপ্রকাশ করে উত্তরণে ছয় দফা সুপারিশ করেছে কমিটি।

শুক্রবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবনে তেলের জাহাজডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ আসলে ছিল বালু ও পাথর টানার জীর্ণ জাহাজ। এই সাধারণ কার্গো জাহাজকে তেলের ট্যাংকারে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যেটি তেল বহনে অনুপযুক্ত। এর কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। এটি অবৈধ রুটে বেআইনিভাবে তেল পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। এক্ষেত্রে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অমার্জনীয়।

“আমরা মনে করি, তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজের দুর্ঘটনা সরকারের অপরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফসল। এই জাহাজটির মালিক একজন মন্ত্রীর শ্যালক। জাহাজটি প্রায়ই খুলনা থেকে তেল নিয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নিষিদ্ধ রুটে অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিত। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিই এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।”

সকালে গুলশানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন হয়। নির্দিষ্ট সময়ের একদিন আগেই বুধবার রাতে দলীয় প্রধানের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হাফিজ।

গত ২০ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শেলা নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। দুদিন পর তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন।

প্রতিবেদনে শেলা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনার কারণ, সুন্দরবনের বনাঞ্চল ও জীব-বৈচিত্র্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সরকারের ব্যর্থতা ও পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করণীয় প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির ৬ দফা সুপারিশগুলো হলো- সুন্দরবন রক্ষায় শেলা নদী ও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সকল নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা, অবিলম্বে ঘষিয়াখালী-মংলা চ্যানেল চালু, চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে দখল হওয়া খালসমূহে অবৈধভাবে নির্মিত বাঁধ অবিলম্বে অপসারণ, সুন্দরবনের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পসহ কোনো লাল শ্রেণির শিল্প স্থাপন না করা, তেলবাহী ট্যাংকারডুবির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা, নৌপথে টহল জোরদার, অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ, নিরাপত্তা জোরদার এবং সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবস্থাসমূহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষ গঠন।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলে তদন্ত করার সময় দেখেছি, কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। বিরল প্রজাতি ইরাবতী ডলফিন কয়েকটি মৃত দেখতে পেয়েছি। এসব নদীতে তেলের প্রবাহের ফলে ডলফিন ওই এলাকা থেকে সরে গেছে।

“কেবল তাই নয়, যেসব পাখি এই এলাকায় মাটির শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের উপরিভাগে পোকা-মাকড় অনুসন্ধানে বিচরণ করতো, তাদেরও দেখা যায়নি। মাটির উপরিভাগে তেলের আস্তরণ হওয়ায় তার উপর ওই পাখির বিচরণে তাদের প্রজনন ক্ষমতাও কমে যাবে।”

তেল অপসারণে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এর ফলে সুন্দরবনের অসংখ্য খালের ভেতরে তেল ঢুকে বৃক্ষরাজি, মৎস্য সম্পদ, প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, বনবিভাগ প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করলেও অনেকের ধারণা ক্ষতি ৫শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পরিবেশবিদদের মতে, সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি অপূরণীয়, যা টাকার অংকে পরিমাপ করা যাবে না।

তেলবাহী ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এর মাস্টার নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘রহস্যজনক’ অভিহিত করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় লোকজনের অভিমত জাহাজের মাস্টারের নিখোঁজ হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনা রহস্যজনক। এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।

সরকারের বিরুদ্ধে ‘উদাসীনতার’ অভিযোগ এনে তদন্ত প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ট্যাংকার ডুবির ৪৮ ঘণ্টার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্ধার কার্যক্রম ও জরুরি ভিত্তিতে তেল অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনের ওপর নেমে আসে মহাবপর্যয়।

দুর্ঘটনার তিনদিন পর নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ছয় দিন পর বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর টেলি কনফারেন্সে প্রয়োজনীয় নির্দেশেরও কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পরপরই নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে নিয়োজিত করা হলে ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করে বিএনপির তদন্ত কমিটি।

তেল অপসারণে কাজ করা লোকজন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চর্মরোগ থেকে পরে ক্যান্সার হতে পারে।

প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, শেলা নদীতে সাময়িক বন্ধ থাকা নৌযান চলাচল আবারও চালুর পাঁয়তারা চলছে। ঘষিয়াখালী-মংলা নৌ চ্যানেলের মাটি কাটার কাজ মন্থর গতিতে চলছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সুন্দরবন এলাকার খালগুলোকে একশ্রেণির দখলবাজরা দখল করে চিংড়ির ঘের বাণিজ্য করছে। ফলে নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে পলিতে ভরাট হয়ে গেছে ঘষিয়াখালী চ্যানেল।

সুন্দরবন রক্ষায় আগামী দুই মাসের মধ্যে ঘষিয়াখালী-মংলা চ্যানেল চালুর দাবি জানিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, “এজন্য প্রয়োজনে আমাদের সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে খনন কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে।”

এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ বলেন, সুন্দরবন এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে সবুজ অর্থায়নে আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়া থেকে দেশ বঞ্চিত হবে।

হাফিজউদ্দিন আহমেদ জানান, তদন্ত কাজে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক-বিশেষজ্ঞ সহায়তা করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খুলনা মহানগর সভাপতি ও সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম মঞ্জু, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, বাগেরহাট জেলা সভাপতি আবদুস সালাম, খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মনা, কেন্দ্রীয় সহ দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি ও শামীমুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।