আন্দোলনে ভেসে যাবে সরকার: খালেদা

৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশ্নের মধ্যে খালেদা জিয়া বলেছেন, এবার সরকার পতনে সফল হবেন তারা।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Dec 2014, 12:52 PM
Updated : 21 Dec 2014, 02:52 PM

“জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অচিরেই আন্দোলন শুরু করতে হবে। এটি হবে জনগণের আন্দোলন। সেই আন্দোলনে স্বৈরাচারী, অবৈধ সরকার তাসের ঘরেরর মতো ভেসে যাবে, ইনশাল্লাহ,” রোববার মুক্তিযোদ্ধা দলের এক সমাবেশে বলেন তিনি।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আগামী বছরের শুরুতেই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ইতোপূর্বে বলেছেন, এবার সফল হয়েই রাজপথ ছাড়বেন তিনি।

চলতি বছরের শুরুতে নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ভোটের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে বলছেন বিএনপি চেয়ারপারসনকে।

“সরকার আমাদের কোনো আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছে না। তাই আমাদের বসে থাকার আর কোনো উপায় নেই। দেশের জনগণ আন্দোলন চায়, পরিবর্তন চায়। আমি যেখানেই যাচ্ছি, দলে দলে লোক এসে আন্দোলনের দাবি জানাচ্ছে,” মুক্তিযোদ্ধা দলের সমাবেশে বলেন খালেদা।

“এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হবে,” বলেন ২০ দলীয় জোট নেত্রী, যে জোটের গত বছরের সহিংস আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। 

বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা দলের ডিসেম্বর মাসজুড়ে কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই সমাবেশ হয়, যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন খালেদা জিয়া।

সারাদেশ থেকে এই সমাবেশে আসা সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার মাথায় ছিল লাল-সবুজ ক্যাপ ও হাতে জাতীয় পতাকা। জিয়াউর রহমানের নামে স্লোগান ছিল তাদের কণ্ঠে।

সমাবেশে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন, খুরশীদ আলম, জিয়াউল হক বাবু, মতিউর রহমান মতি, মো. শাহজাহান, আবু ইউসুফ হাওলাদার, আবদুর আজিজ মিয়া, মো. রমজান আলী, আবুল কালাম ও মোহন মিয়াকে আর্থিক সহায়তা করেন তিনি।

বিকালে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের আগে দুপুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় পতাকা তোলার মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়।

এরপর বিভিন্ন নেতার বক্তব্যের পর খালেদা জিয়া আসেন। এক ঘণ্টার বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা মেলে ধরে আন্দোলনের পক্ষে যুক্তিতুলে ধরেন।

“আজ দেশে গণতন্ত্র নেই। বৈধ কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নেই। যে গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তা আজ আবার লুণ্ঠিত। ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ন্যায়বিচার ও সুবিচার হরণ করা হয়েছে।”

সরকার এক বছর পার করলেও মানুষের অবস্থা ও দেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন আন্দোলনে শামিল হতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিও আহ্বান জানান।

মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও স্মারকসমূহ সংরক্ষণে প্রকল্প গ্রহণের কথা তুলে ধরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়নি দাবি করে তিনি বলেন, “একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে তারা মুক্তিযুদ্ধের (মুক্তিবাহিনীর) সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী কিংবা চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুর রবের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি। তাদের আস্থাভাজন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।

“সেই আস্থাভাজন ব্যক্তিটিও যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পূর্বাহ্নের প্রস্ততিহীনতা সম্পর্কে কিছু সত্য কথা বলে ফেললেন, তখন তাকেও পাকিস্তানের চর আখ্যা দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেনি। এটা হলো তাদের চরিত্র।”

মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা প্রণয়নে জালিয়াতি ও দলীয়করণের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তা ‘পরিশুদ্ধ’ করবে।

নিজের স্বামী জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করে খালেদা বলেন, “বেতার মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ উন্নীত হয়েছিল বিপ্লবে, প্রতিরোধ যুদ্ধ উন্নীত হয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। সেই ঘোষণার কণ্ঠ দেশবাসী শুনেছে, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।

“ইতিহাসে আরও সত্য আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের কথা বলেন, তাহলে শুনেন। ১৯৭১ সালে ১-৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় চা-বাগানে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কমান্ডাররা প্রথম বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে মুক্তিফোজ গঠন, সেক্টর বিভাজন ও সর্বাধিনায়ক নির্ধারণ ও সেক্টর কমান্ডারদের দায়িত্ব ও যুদ্ধ এলাকা বণ্টন করা হয়।”

“সেই বৈঠকে রেজুলেশন নেওয়া হয়, নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে খুঁজে বের করে তাদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে। সেই সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার আহ্বান জানাতে হবে। এর অর্থ কী? স্বাধীনতা যুদ্ধের যে ঘোষণা নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের দেওয়ার কথা ছিল, সেটা তারা দিতে পারেনি। সেটা দিয়েছেন জিয়াউর রহমান।”

১৪ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও অধিনায়ক ঠিক করার কাজটিও সেক্টর কমান্ডাররা করেন বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া।

“একটা প্রবাসী সরকার যে গঠন করতে হয়, সেই তাগিদটাও মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের কাছ থেকে এসেছিল।”

“স্বাধীনতা যুদ্ধের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানে এসব দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মনগড়া কথা বলে। ওইসব দুর্বলতা ও তাদের খণ্ডিত-বিকৃত ইতিহাসকে শুদ্ধ করে বলতে গেলেই তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কথার জবাব না দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি ধমকি দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চায়।”

সমাবেশে এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, ‘“একাত্তরের জিয়াউর রহমানই চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগারদের বলব, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মিথ্যাচার করে কোনো লাভ হবে না।”

তারেক রহমানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, “ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। গত ৫ বছর যাবত উনি (প্রধানমন্ত্রী) এভাবেই কটূক্তি করে যাচ্ছেন, ইট মেরে যাচ্ছেন। আমার মনে হল, এত বছর পর সুদুর লন্ডন থেকে তারেক রহমান একটা মাত্র পাটকেল দিলেন।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “আওয়ামী লীগ কখনোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। তারা যদি বিশ্বাস করত, তাহলে গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করত না।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “সরকারের মন্ত্রীরা বলতে শুরু করেছে, বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না। এটা কি আওয়ামী লীগের তালুকদারি? আমরা কেউ ভেসে আসিনি। আপনারা (সরকার) গুলি করবেন, সমাবেশ-মিছিল করতে দেবেন না, দেশনেত্রীকে গালিগালাজ করবেন। এটা আর সহ্য করা হবে না।”

ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, “শেখ মুজিবর রহমান একাত্তরের মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপসরফা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই তারেক রহমান পাকবন্ধুর কথা বলেছেন।”

মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম, শাহজাহান ওমর বীরউত্তম।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুস সালাম, ফজলুর রহমান, শাহ মো. আবু জাফর, ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল, কাজী আজিজুল হক লেবু কাজী, আবুল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিউজ্জামান খোকন।

আবদুল মঈন খান, আবদুল মান্নান, এএসএম আবদুল হালিম, আহমেদ আজম খান, এম এ কাইয়ুম, আমানউল্লাহ আমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, নুর মোহাম্মদ খান, শাহজাদা মিয়া, রাবেয়া সিরাজ, শিরিন সুলতান, মারুফ কামাল খানসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশে ছিলেন।