ক্ষোভ-বিক্ষোভ-গুঞ্জনে লতিফময় এক দিন

প্রায় দুই মাস আগে নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে মন্তব্যের জন্য মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারানো আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফেরার পর দিনজুড়ে ছিলেন আলোচনায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2014, 07:28 PM
Updated : 25 Nov 2014, 01:10 PM

গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ থেকে হরতালের হুমকি, আলোচনা সভা-বিবৃতিতে ক্ষোভ, সংসদে উত্তাপ- সবই ছিল সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।

তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রবীণ এই রাজনীতিক যে কোথায় রয়েছেন, তার কোনো হদিস মেলেনি। সকালে একবার তার হাই কোর্টে জামিন নিতে যাওয়ার গুঞ্জন ছড়ালেও তাকে দেখা যায়নি আদালত প্রাঙ্গণে।

লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরার পরদিন মন্ত্রিসভার নির্ধারিত বৈঠক ছিল এবং সেখানে সাবেক সহকর্মীকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ‘ফিসফাস’ কথা-বার্তা হয়েছে বলেও এক মন্ত্রী জানিয়েছেন।

“কিছু সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী সভাকক্ষ ছেড়ে যাওয়ার পর লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ফিসফাস শুরু হয়েছিল, কিন্তু তবে প্রধানমন্ত্রী সভাকক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওই কানাঘুষা শেষ হয়ে যায়, আর কোনো কথা হয়নি,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মন্ত্রী।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজে যাওয়াকে ‘অর্থ অপচয়’ বলার পরপরই তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার এক পর্যায়ে ইসলামী দলগুলো আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয়।

এরপর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয় টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। পরে দল থেকেও বহিষ্কৃত হন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য।

এই পুরো সময়টা বিদেশেই ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যান ভারতে, সেখান থেকে আকস্মিকভাবে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

বিমানবন্দর থেকে তিনি কোথায় গেছেন, তার হদিস জানা যায়নি। তার মোবাইল ফোনে কল করলেও তার ধরেননি তিনি।

মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর নিজের সরকারি বাড়ি থেকে তার মালপত্র সরিয়ে নেয় পরিবারের সদস্যরা। ধানমণ্ডিতে তার যে নিজের বাড়ি রয়েছে, সেখানেও তিনি ওঠেননি বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী

লতিফ সিদ্দিকী দেশের বাইরে থাকা অবস্থায়ই তার বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে, তার কয়েকটিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে।

এর মধ্যেই বিমানবন্দর থেকে লতিফ সিদ্দিকীর ‘নির্বিঘ্নে’ চলে যাওয়ায় সরকারের সায় দেখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

“এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, লতিফ সিদ্দিকীর পেছনে সরকারের একটা বড় রকমের সমর্থন রয়েছে। তা না হলে কিভাবে তিনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হয় না?”

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদও লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার না করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এক বিবৃতি দিয়ে।

“তিনি কী করে পুলিশের সামনে বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে গেলেন তা বোধগম্য নয়। তিনি কি আইনেরও উর্ধ্বে?”

সংসদে আলোচনায় এরশাদের দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তার সংসদ সদস্যপদ খারিজের দাবিও তোলেন।

একই দাবি তোলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম। তিনি সেই সঙ্গে দাবি করেন, লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কোনো সহানভূতি নেই বলে তিনি নিশ্চিত।

লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের দাবি ওঠার প্রেক্ষাপটে তা বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের কাছে ‘আইনি জটিলতার’ অজুহাত তুলে ধরেন।

তবে সংসদ সদস্যপদ থাকার পরও লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন নেই বলে শিরীন শারমিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

এর মধ্যেই একটি মামলায় ঢাকার এক আদালত সাবেক এই মন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে জারি করা পরোয়ানা তামিলের জন্য পুলিশকে তাগিদও দিয়েছেন।

লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ক্ষোভ দেখে প্রবীণ সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আইনি দিকগুলো তুলে ধরে বলেন, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আইনি বাধা না থাকলেও সংসদ সদস্যপদ খারিজের ক্ষমতা স্পিকারের নেই।  

সকাল থেকে আলোচনার মধ্যেই হাই কোর্টে খবর রটে, মামলায় আগাম জামিন নিতে আদালতে আসছেন লতিফ সিদ্দিকী। তাকে প্রতিরোধে মিছিলও বের করে ফেলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। কিন্তু সারাদিনেও হাই কোর্টে দেখা যায়নি তাকে।

রোববার রাতে লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরার খবর প্রকাশিত হলেই হেফাজতে ইসলাম তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিল। 

সোমবার রাজপথে নেমে বিক্ষোভও দেখায় সংগঠনটি। সেই সঙ্গে বুধবারের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের জন্য সরকারকে সময় বেঁধে দেন সংগঠনটির নেতারা।

তা নাহলে বৃহস্পতিবার সারাদেশে হরতালের সিদ্ধান্ত হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফী দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলোর পাশাপাশি হেফাজতবিরোধী ইসলামী সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতও লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।

ইসলামী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ আর হরতালের হুমকির মধ্যেই শেখ শওকত হোসেন নীলু নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক জোট এনডিএফ মঙ্গলবার হরতাল ডেকে বসে।

নীলু সম্প্রতি ২০ দল ছেড়ে এসে এই জোট গঠন করেন, যার পেছনে সরকারের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ। 

লতিফকে নিয়ে হরতালের ঘোষণায় চলমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের অভিভাবকরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তবে নীলুর ডাকা হরতালের দিন পরীক্ষা পেছায়নি কর্তৃপক্ষ।