ধর্মের অপব্যবহার করেছেন ‘ইসলামের পণ্ডিত’ নিজামী

যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী একাত্তরে বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তরুণদের উসকে দিতে সচেতনভাবে ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন বলে উঠে আসে আদালতের পর্যবেক্ষণে।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2014, 06:47 PM
Updated : 10 May 2016, 07:17 PM

সব বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে বুধবার মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর তার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল; চলতি বছর ৬ জানুয়ারি সেই দণ্ডই বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

জামায়াত আমির নিজামী চার দশক আগে এই দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে নিজামীর এই সব অপরাধের বিষয়ে ধর্মের শিক্ষা তুলে ধরতে বিচারিক বিধানের বাইরে ইসলামের বিধান হিসেবে কোরআন ও হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. ইনায়েতুর রহিম।

এছাড়াও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা তুলে ধরতে মদিনা সনদের কথা উল্লেখ করে নিজামীর একাত্তরের কর্মকাণ্ডের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয় রায়ে।

আদালত বলে, “আমরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে, মতিউর রহমান নিজামী ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় আল্লাহ ও পবিত্র ধর্ম ইসলামের নামের অপব্যবহার করে বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।

“অভিযুক্ত মতিউর রহমান নিজামী একজন প্রখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত (আসামি পক্ষের দাবি অনুযায়ী) হয়েও তিনি কোরআনের আদেশ এবং মহানবীর শিক্ষার পরিপন্থি হয়েই আলবদর বাহিনী গঠন করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা ও নিধন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতা ও অনুমোদন আদায়।”

রায়ে বলা হয়, ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি নিজামী জনসমক্ষে মুক্তিকামী বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যায়িত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে নিজ সংগঠনের সদস্যদের উৎসাহিত করতেন এবং উসকানি দিতেন।

বিভিন্ন সভা সমাবেশে তার মুখ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার সমর্থকদের ‘দুর্বৃত্ত’ ও ‘ভারতের দালাল’ আখ্যা শুনে রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের ‘ভালো মুসলিম’ মনে করতো না।

এছাড়াও নিজামী বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায় ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর’, ‘হিন্দুরা সবসময়ই মুসলিমদের শত্রু’ এবং ‘ইসলাম আর পাকিস্তান এক ও অভিন্ন' জনসভায় প্রচার করতেন।

নিজামীর এসব উক্তিকে ‘রাজনীতিতে ইসলামের অপব্যবহারের ধ্রুপদী উদাহরণ’ আখ্যায়িত করে রায়ে বলা হয়, রাজাকার ও আল বদর বাহিনীর তরুণ সদস্যরা এসব ভ্রান্ত উক্তিকেই সত্য এবং ‘ইসলামিক আদর্শ’ বলে মনে করতো এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহিত হতো।

২০০৫ সালে জামায়াতে ইসলামীর এক সমাবেশে মতিউর রহমান নিজামী

বিচারকরা বলেছেন, সাধারণভাবে ইসলাম অসাম্প্রদায়িক হওয়ার শিক্ষা দিলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতারা নিজ সংগঠনের বাইরের সবাইকেই ‘খারাপ মুসলিম’ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুর্বৃত্ত’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাদের অনুসারীদের চিন্তাভাবনাকে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছিলেন। একই সঙ্গে হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজে উসকে দিতেন।

এই প্রসঙ্গে কোরআনের একাধিক সুরার একাধিক আয়াত ও হজরত মুহাম্মদের বিদায়ী হজের ভাষণ নিয়ে একটি হাদিস তুলে ধরা হয় রায়ে।

এগুলোর মধ্যে সুরা মায়িদার ৩২তম আয়াতের একটি অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়, “হত্যা বা দেশে বিশৃঙ্খলার (বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য) জন্য শাস্তি হিসেবে ছাড়া যদি কেউ কাউকে হত্যা (অন্যায়ভাবে) করে তাহলে তাতে সে মানবতাকেই হত্যা করল।”

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ইসলাম শুধু মুসলিমদের হত্যাই নিষিদ্ধ করেনি, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানবহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে।

এ বিষয়ে বিদায় হজের ভাষণের নিয়ে আবু হুরাইয়ার বর্ণিত একটি হাদিসের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, শুধু মুখের কথা দিয়ে কেউ যদি একজন বিশ্বাসীকে হত্যা করতে সাহায্যও করে, তবে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তার কপালে লেখা থাকবে, ‘আল্লাহর ক্ষমার অযোগ্য’। ”

বিচারকরা বলেন, “কোরআনের এসব আয়াত ও হাদিসগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি, বিশদ নকশার অংশ হিসেবে নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা, তাদের সম্পদ লুট করা, তাদের মৌলিক অধিকার হরণ করা, বলপ্রয়োগ করে তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করা ‘ইসলাম’ ও ‘মানবতার’র ধারণার পরিপন্থি।

‍“উপরের দর্শনগুলোর আলোকে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই যে, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর সংঘটিত হত্যা, নিধন, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো সম্পূর্ণভাবে কোরআন ও হাদিসের অনুমোদনের বাইরে ।” নিজামীকে মন্ত্রী করা ছিল শহীদদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’