অবশেষে বুধবার নিজামীর রায়

দুই দফা পেছানোর পর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় হতে যাচ্ছে বুধবার, যার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগ রয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2014, 05:26 AM
Updated : 28 Oct 2014, 03:57 PM

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার রায়ের জন্য এই দিন ঠিক করে দেয়।

প্রায় এক বছর ঝুলে থাকার পর বাংলাদেশের মানুষ নিজামীর রায় পেতে যাচ্ছে, যিনি জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হিসাবে একাত্তরে আলবদর বাহিনীরও প্রধান ছিলেন।

স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

আর এই রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতীক জামায়াতগুরু গোলাম আযমের মৃত্যুর ছয় দিনের মাথায়। ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এই যুদ্ধাপরাধী ৮৯ বছর সাজা বাকি থাকতেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।   

২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি হবে দশম রায়।

সাবেক চার দলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। রায়ের জন্য গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ৭১ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতাকে মঙ্গলবারই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

প্রথম দফা যুক্তিতর্ক শেষে গতবছর ১৩ নভেম্বর নিজামীর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হলেও ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টিএম ফজলে কবীর অবসরে গেলে এ আদালতের বিচার কার্যক্রমে কার্যত স্থবিরতা তৈরি হয়। নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দায়িত্ব নেয়ার পর আসামিপক্ষের আবেদনে নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনেন।

দ্বিতীয় দফা যুক্তিতর্ক শেষে গত ২৪ মার্চ আবারো মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার জন্য ২৪ জুন তারিখও ঠিক করা হয়। কিন্তু সেদিন সকালে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীর অসুস্থতার কথা জানিয়ে চিঠি দিলে তা আবার ঝুলে যায়।

এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে ৩ জুলাই  একটি প্রতিবেদন দেয়, যাতে নিজামী ‘সুস্থ’ আছেন বলে জানানো হয়।  

প্রথম দফায় রায় অপেক্ষমাণ রাখার সাড়ে ১১ মাস পর অবশেষে বুধবার রায়ের জন্য আবারো দিন রাখেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।

২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করার পর একই বছরের ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপর ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেয়।

এরপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮ মে জামায়াত আমিরের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে একাত্তরের ডিসেম্বরে পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রাম ঘেরাও করে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা ও ৭২টি বাড়িতে আগুন দেয়া, ডেমরা ও বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জনকে গুলি করে হত্যা, সাঁথিয়া উপজেলার করমজা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনাও রয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন।

আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কে এ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সালাম মুকুল।

সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গতবছর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রথম দফা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত না হওয়ায় তাদের লিখিত যুক্তিতর্ক জমা দিতে বলে ১৩ নভেম্বর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দায়িত্ব নেওয়ার পর চলতি বছর ১৬ থেকে ২৪ মার্চ তিনি নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনেন। এরপর দ্বিতীয়বারের মতো মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়।

২৪ জুন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করায় রায় আবারো পিছিয়ে যায়।

দশম রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।  

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষের আপিল শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে আপিল বিভাগ।  

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।    

গতবছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ১ অক্টোবর  সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারাও রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।

আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।