গোলাম আযম: দল নয়, শেষ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পরিবার

তিনি জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু, একাত্তরে তার নেতৃত্বেই জামায়াতে ইসলামী বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বিরোধিতায় যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছে; মৃত্যুর পর সেই গোলাম আযমের শেষকৃত্যের আয়োজন চলছে দৃশ্যত শুধুই পরিবারের সিদ্ধান্তে।

শামীমা বিনতে রহমান ও মইনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2014, 09:55 PM
Updated : 24 Oct 2014, 10:02 PM

তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জানিয়েছেন, শনিবার জোহরের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার বাবার জানাজা হবে। দাফন হবে মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে। আর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ‘একেবারেই পারিবারিকভাবে’।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযম দেশের সবচেয়ে বড় ও উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে  মারা যান, যার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। এর মধ্য দিয়ে তার ৯০ বছর কারাদণ্ডের সাজা শেষ হয় মাত্র এক বছরে।

রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে সকালে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। মগবাজারের বাসায় নিয়ে মরদেহ রাখা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি লাশবাহী গাড়িতে।

সাবেক আমিরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামী এক শোকবার্তায় বলেছে, ‘মিথ্যা মামলায়’ আটক থাকা অবস্থায় ‘পরিবারের সান্নিধ্য থেকে ও উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত’ অবস্থায় তার এই মৃত্যু ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক’।

তবে বৃহস্পতিবার রাত থেকে গোলাম আযমের জানাজা-দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ছেলে আব্দুল্লাহিল আযমী ও আইনজীবী তাজুল ইসলাম ছাড়া দলের শীর্ষ কোনো নেতাকে গণমাধ্যমের সামনে আসতে দেখা যায়নি।      

তাজুল বৃহস্পতিবার রাতে বলছিলেন, গোলাম আযম মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত হতে চেয়েছেন এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী অথবা মতিউর রহমান নিজামীর ইমামতিতে জানাজা পড়ানোর ইচ্ছার কথা পরিবারকে জানিয়ে গেছেন।

“তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবার যদি সিদ্ধান্ত নিতে চায় তবে আইনজীবীরা সরকারের কাছে আবেদন জানাবেন।”

তাৎক্ষণিকভাবে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাজুলের বক্তব্যের সমালোচনা আসে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবিরের কথায়। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের দিয়ে জানাজা করার ‘ইচ্ছা’ জানিয়ে গোলাম আযম মৃত্যুর সময়ও ‘রাজনীতি’ করে গেলেন।

শুক্রবার সকালে এ বিষয়ে সরকারের তরফের বক্তব্যও পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সরাসরিই বলেন, গোলাম আযমের জানাজায় ইমামতির জন্য কারাবন্দি মতিউর রহমান নিজামী বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্যারোলে মুক্তি চাওয়ার কোনো ‘যৌক্তিকতা’ নেই।

বৃহস্পতিবার রাতে আইনজীবী ও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, গোলাম আযমের প্রবাসী পাঁচ ছেলে দেশে ফিরলে জানাজা-দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এ জন্য তিন-চার দিন সময়ও লাগতে পারে।  

কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল্লাহিল আযমী জানিয়ে দেন, শনিবারই তার বাবার জানাজা-দাফন হবে। আর তিনি নিজেই জানাজা পড়াবেন। 

২০০৯ সালে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া আযমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনার লাশের জানাজা এবং দাফন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত একেবারেই পারিবারিকভাবে নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী, জানাজা পড়াব আমি নিজে। আর তাকে দাফনও করা হবে মগবাজারের পারিবারিক কবরস্থানে।”

ইসলামে মৃত ব্যক্তিকে ‘যতো দ্রুত সম্ভব’  দাফন করার নির্দেশনা থাকলেও গোলাম আযমের ক্ষেত্রে বিলম্ব নিয়ে দলে এবং স্বজনদের কারো কারো মধ্যে ‘অস্বস্তির’ গুঞ্জন শোনা যায় শুক্রবার দুপুরে। তবে দলের কোনো নেতা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।

জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইটে ‘ইসলামের নৈতিকতা ও আচরণ’ প্রসঙ্গে এক জায়গায় বলা হয়েছে-  মৃত্যুর পরপরই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন সম্পন্ন করতে হবে। আর জানাজায় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা অন্যদের আসার জন্য প্রতীক্ষা না করে জানাজায় অংশ নেওয়া উচিত।

জুমার নামাজের পর কেন গোলাম আযমের জানাজা হয়নি তা নিয়েও কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তার ছেলে বলেন, “এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। আর মৃত্যুর পর যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করা ফরজও নয়। ইসলামী শরিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এ রকম হাজার হাজার হাদিস আছে, একটা হাদিস না মানা হলে সেটা বড় বিষয় না। বৃহত্তর স্বার্থে, তার ঘনিষ্ঠ যারা তাদের জন্য অপেক্ষা করা হয়েছে।"

সেই ‘বৃহত্তর স্বার্থ’  রাজনৈতিক কিনা- জানতে চাইলে আব্দুল্লাহিল আযমী বলেন, “দলীয় নয়, একেবারেই পারিবারিক। আমি ছাড়া বাকি পাঁচ ভাই থাকেন দেশের বাইরে, তাদের জন্যই অপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেল তারা কেউই আসছেন না। তবে দুই ভাইয়ের স্ত্রী এবং সন্তানরা আসছেন জানাজার আগেই।”

অথচ জামায়াত এমন একটি দল, যার সদস্যদের ব্যবসা, কর্ম ও জীবনযাপনের অনেক কিছুই দলীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে চলে বলে বিশ্লেষকদের মত।    

শুক্রবার দুপুরে ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের দেখার জন্য জামায়াতের এই তাত্ত্বিক গুরুর লাশ রাখা হয় মগবাজারের কাজী অফিস গলির বাসার সামনে।

এ সময় সেখানে উপস্থিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বলেন, “অনেকক্ষণ ওখানে থেকে আমি দেখলাম মানুষ আসছেন, লাশ দেখে চলে যাচ্ছেন। তাদের দেখে মনে হয়েছে পাশের বাড়ির কেউ মারা যাওয়ায় তারা লাশ দেখতে এসেছেন। তারা কোনো রাজনৈতিক নেতার লাশ দেখছেন বলে মনে হয়নি।”

জামায়াতের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি গোলাম আযমের মৃত্যুর পর কোনো প্রতিক্রিয়া বা শোক প্রকাশ করে কোনো বিবৃতি শুক্রবার রাত পর্যন্ত দেয়নি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিযোগ, জিয়াউর রহমানের আমলে গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের দেশে ফেরার সুযোগ ও ‘পুনর্বাসনের’ ব্যবস্থা হয়। আর পরে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া সেই যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসান।

অবশ্য খালেদা জিয়ার দাবি, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এই গাঁটছড়া “শুধুই একটি নির্বাচনী সমঝোতা। এখানে আদর্শের কোনো ব্যাপার নেই।”

শনিবার  গোলাম আযমের জানাজায় যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেই বলে কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ জানাজায় যোগ দিতে পারেন। 

১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযমের পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাঁওয়ে। তার লাশ যাতে সেখানে না নেওয়া হয়, সেজন্য শুক্রবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশে দাফন না করে তার লাশ পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধনও করেছে।

গত শতকের ৫০ এর দশকে সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন গোলাম আযম। ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন  গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

গতবছর ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া ৯০ বছর সাজার রায়েও তাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ফাইল ছবি

স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম, সেখান থেকে যান লণ্ডনে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে, অর্থাৎ পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে।

এরপর ১৯৯১-৯৬ বিএনপি সরকারের সময়ে জামায়াতের আমির পদে ফেরেন গোলাম আযম। আদালতের এক আদেশে ফিরে পান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। 

গোলাম আযমের ‘সঠিক জীবন বৃত্তান্ত’ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে শুক্রবার একটি বিবৃতি দিয়েছে জামায়াতের সহযোগী ইসলামী ছাত্রশিবির।

তাতে অনেক প্রশংসাসূচক বিশেষণের মধ্যেই বলা হয়েছে,  “গোলাম আযমের আলোচিত রাজনৈতিক জীবনকে বিতর্কিত করেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান। তিনি দীর্ঘদিন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসক চক্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও বিশ্বাস করতেন একটি ইসলামিক রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

“তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা ভারতের শাসক গোষ্ঠীর ভূমিকার কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গোলাম আযম স্বাধীনতার বিরোধিতা করার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনে করার যথেষ্ঠ কারণ থাকলেও, এ সিদ্ধান্ত তাকে রাজনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে এর জন্য দায়মোচন করতে হয়েছে।”

অবশ্য একাত্তরের ভূমিকার জন্য মৃত্যুর আগ পর‌্যন্ত গোলাম আযমের কোনো অনুশোচনা ছিল না তার ছেলের দাবি।

আব্দুল্লাহিল আযমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনার অনুশোচনা হওয়ার তো কোনো প্রশ্ন ওঠে না। উনি তো কোনো অপরাধ করেননি। উনার বিরুদ্ধে আদালত বলতে পারেনি যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।”

বাবার মৃত্যু নিয়ে কোনো রাজনীতি চলছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি গত দুদিন ধরে তাকে নিয়ে ব্যস্ত। টিভিও দেখতে পারিনি। শুনেছি কেউ কেউ কটূক্তি করছে। আমি এগুলো নিয়ে পরোয়া করি না।”