‘আঙুল বাঁকা’ করার হুঁশিয়ারি খালেদার

নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।

সুমন মাহমুদ নীলফামারী থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2014, 10:43 AM
Updated : 9 Dec 2014, 11:09 AM

“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে,” বৃহস্পতিবার নীলফামারীর জনসভায় বলেছেন তিনি।

জনসভায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের এই বক্তব্যের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।

আন্দোলনের নামে যে কোনও নাশকতা কঠোরভাবে দমনের পাল্টা হুঁশিয়ারিও দেন সরকার প্রধান।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার বিশ্ববাসীর কাছেও স্বীকৃতি পায়নি বলে দাবি করেন খালেদা। এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন,  সব বিশ্বনেতাই তার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে গণসংযোগের অংশ হিসেবে নীলফামারীতে এই জনসভা করেন খালেদা। আগামী ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, ওই নির্বাচন বর্জন ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ ছিল।

ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “বিশ্বের কোনো দেশ এই অবৈধ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু ফটোসেশন, ছবি তুললে মনে করবেন না স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। গণতন্ত্র না থাকলে কোনো দেশ কাউকে স্বীকৃতি দেয় না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বিদেশিরা দেখেছে, তারা জনগণের ভোট পায়নি।’’

ওই নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের জন্য সংলাপের দাবি জানিয়ে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সাড়া মিলছে না। বরং নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।  

খালেদা বলেন, “ভালো কথায় কাজ না হলে আন্দোলন করে সরকারকে বিদায় করে অবাধ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে। সকলেই ভোটের অধিকার ফিরে পাবে।”

ভোট বর্জনের পর বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে তার জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

“৫ জানুয়ারি আমার ডাকে সারাদেশে জনগণ রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু ঢাকায় আন্দোলন হয়নি। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এবার ঢাকায়ও আন্দোলন হবে।”

কর্মসূচির জন্য নেতাকর্মীদের অপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে খালেদা বলেন, “সময়মতো এই আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। আপনারা প্রস্তুতি নিন। এখনই নয়, সারাদেশে জনগণের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে নিই। এরপর আন্দোলনের ডাক দেব।”

নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনে নীলফামারীসহ এ অঞ্চলে নিহত ১৪ জনের প্রতি বক্তব্যের শুরুতেই শ্রদ্ধা জানান খালেদা।

দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করে খালেদা বলেন, এই সরকার জনগণের জন্য কোনও কাজ করছে না।

“সরকার অনেক ওয়াদা করেছিল। ১০ টাকায় চাল খাওয়াবে, তারা কি সে ওয়াদা পালন করেছে? করেনি। আমাদের সময় সারের যে মূল্য ছিল এখন তার চেয়ে তিন গুণ বাড়িয়েছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা যে টাকা দিয়ে উৎপাদন করে সে খরচই ওঠে না।”

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও জনগণের ‘ধরা ছোঁয়ার বাইরে’ বলে দাবি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা।

আওয়ামী লীগ সরকার ‘মিথ্যা তথ্যের ওপর’ টিকে আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে, তা মিথ্যা বলে। আপনারা (সমাবেশ) কি বিদ্যুৎ পান?”

“পান না, গলার জোরটা একটু বাড়ান। এ সরকার মিথ্যার উপরে টিকে আছে। বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।”

সরকারের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, “নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করুন। তখন আপনারা যদি বিজয়ী হন, দেশ আপনারাই পরিচালনা করবেন। এভাবে ভোট চুরি করে বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না।’’

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকীর করা ধর্মীয় উসকানির মামলার বিষয়ে ইংগিত করে খালেদা জিয়া বলেন, “তাদের (সরকারের) এক মন্ত্রী হজ নিয়ে কটূক্তি করেছে। এর প্রতিবাদে আলেমরা মিছিল করলে তাদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। কাজেই কারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তা জনগণ ভালোভাবে জানে।’’

র‌্যাব ‘নষ্ট হয়ে গেছে’ দাবি করে এই এলিট বাহিনীর বিলুপ্তিও দাবি করেন বিএনপি প্রধান।

দুর্নীতি দমন কমিশন ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তি দিচ্ছে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, দুদক এখন দুর্নীতি দমন নয়, ‘দুর্নীতি করার কমিশনে’ পরিণত হয়েছে।’

“মন্ত্রী-এমপিরা টাকা-পয়সা লুট করে মোটা-তাজা হচ্ছেন।… কেবল তাই নয়, লুটপাটের টাকা জমিয়ে মন্ত্রীরা বুড়ো বয়সে বিয়ে করছেন। তাদের ছেলে মেয়েদেরও বিয়ে দিচ্ছেন।’’

আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি প্রশাসনকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।

ঢাকা থেকে বুধবার রওনা হয়ে বগুড়ায় রাত কাটিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া ৩টায় জনসভাস্থল নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে (বড় মাঠ) পৌঁছান বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি মঞ্চে উঠলে নেতা-কর্মীরা করতালি দিয়ে তাদের নেত্রীকে স্বাগত জানায়।

সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর নবম সংসদের নির্বাচনী প্রচারে বিএনপি চেয়ারপার্সন নীলফামারীর শহীদ মিনারের পথসভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারপর এটাই জেলায় তার প্রথম সফর।

বিএনপির জেলা আহ্বায়ক আনিছুল আরেফিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ২০ দলীয় জোটের এই সভায় নীলফামারীর বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে নেতা-কর্মীরা যোগ দেন।

জনসভায় আসা অনেকের হাতে ধানের শীষ প্রতীক, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বড় বড় প্রতিকৃতি ছিল। সমাবেশমুখি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিলে ছিল বাদক দলও।

নীলফামারী প্রবেশ পথ মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে জনসভাস্থল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কের পথে পথে ছিল ডিজিটাল ব্যানার-ফেস্টুন।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আজম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, এম কামারুজ্জামান এবং একই অভিযোগে বিচারাধীন মতিউর রহমান নিজামী, আবদুস সুবহান ও মীর কাশেম আলীর মুক্তির দাবিতে তাদের ছবি সম্বলিত বিপুল সংখ্যক ডিজিটাল ব্যানারও দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন এবং সরকারের ‘গুম-খুন-গুপ্ত হত্যা-দুর্নীতি ও সরকারের অপশাসনের’ প্রতিবাদে এই জনসভার আয়োজন করে স্থানীয় ২০ দলীয় জোট।

বিএনপির জেলা আহ্বায়ক আনিছুল আরেফিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, যুব দল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, ছাত্র দল সভাপতি রাজিব আহসান, সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান সমাবেশে বক্তব্য দেন।

জোট নেতাদের মধ্য ছিলেন এলডিপির অলি আহমেদ, বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান,  রেদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিশের মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, জাতীয় পার্টিন (কাজী জাফর) টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী,  জাগপার শফিউল আলম প্রধান, ন্যাপের ব্যারিস্টার জেবেল রহমান গানি, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপির খন্দকার গোলাম মূর্তজা, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জেলা জামায়াতের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আবু হেলাল।

জনসভা পরিচালনা করেন জেলা সদস্য সচিব শামুসজ্জামান জামান।

জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন কিছু সময় সার্কিট হাউজে অবস্থান করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর রাজধানীর বাইরে এটা খালেদা জিয়ার পঞ্চম জনসভা।  সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর জামালপুরের জনসভায় বক্তব্য দেন তিনি।