মন্ত্রিত্ব-দলীয় পদ সবই খোয়ালেন লতিফ সিদ্দিকী

হজ নিয়ে এক মন্তব্যের জন্য মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ দুই-ই হারালেন প্রবীণ রাজনীতিক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, সেই সঙ্গে বহিষ্কৃত হতে চলেছেন দল থেকেও।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2014, 05:56 PM
Updated : 13 Oct 2014, 06:08 AM

১৫ দিন আগে প্রবাসে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে করা মন্তব্যের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্টভাষী এবং আত্মম্ভরী হিসেবে পরিচিত ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিককে নিয়ে বাংলাদেশে চলছিল তুমুল আলোচনা।

এরপর বিভিন্ন জেলায় ডজনখানেক মামলা এবং তার বিচার চেয়ে ইসলামী বিভিন্ন দলের সরব হওয়ার মধ্যে নিজের দলের মধ্যেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন লতিফ সিদ্দিকী।

আর তার ধারাবাহিকতায় রোববার এক দিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের প্রজ্ঞাপনও হল, দলের পদ থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্তও হল।

দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলে লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিতের সিদ্ধান্তও হয়েছে।

বিদেশে অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকীকে এখন কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হবে। তার জবাব দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত যে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তই হবে, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের কথায়।

গণভবনে ওই বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিলের পর লতিফ সিদ্দিকীর সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে।

টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য আব্দুল কাদের সিদ্দিকী দল ছেড়েছেন প্রায় দুই দশক আগে, এখন তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও বাদ পড়তে যাচ্ছেন।

টাঙ্গাইল-৪ আসনে চার বারের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছর তা পালন করেন।

এবার পেয়েছিলেন দুই মন্ত্রণালয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দায়িত্ব।  কিন্তু তা পালনের এক বছর না পেরোতেই বিদায় নিতে হল তাকে।

লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী দল রাজনীতির মাঠ উত্তপ্তের চেষ্টা চালানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিল, তার মধ্যেই সহকর্মীর বিষয়ে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যকে ‘গর্হিত’ আখ্যায়িত করে বলেন, “যখন হজ চলছে এবং বাংলাদেশ এত সুন্দর করে হজে যাওয়ার ব্যবস্থাপনা করেছে; যেখানে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হজে গেছেন, ঠিক সেইসময় আমাদের দলের কেউ এই ধরনের কটূক্তি করবে, মন্তব্য করবে, এটা তো কখনোই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না।”

গত ২৮ সেপ্টেম্বর লতিফ সিদ্দিকী নিউ ইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে যখন হজ নিয়ে কথা বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নিতে তখন প্রধানমন্ত্রীও একই শহরে।

নিজেকে ‘অহংকারী’ উল্লেখ করেই লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, “আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী।

“হজে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এরা কোনো প্রডাকশন দিচ্ছে না... শুধু খাচ্ছে, দেশের টাকা ওদের দিয়ে আসছে।”

সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেওয়ারও তিনি কেউ নন।

হজ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে আলোচনার ঝড় তোলে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতিও আসতে থাকে।

বিএনপি লতিফ সিদ্দিকীর শাস্তি দাবি করার পর হেফাজতে ইসলাম তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্তের দাবি তুলে তা না হলে দেশ অচল করার হুমকি দেয়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি তার গ্রেপ্তারও দাবি করেন।

এরপর দেখা যায়, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখা এবং সহযোগী সংগঠনগুলোও লতিফ সিদ্দিকীকে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারের দাবিতে সরব হয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা তখন বলে আসছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ফিরলেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে ৩ অক্টোবরই সংবাদ সম্মেলনে বলেন,মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে লতিফ সিদ্দিকীকে, দল থেকেও বাদ দেওয়া হবে।

কিন্তু এই সময়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন হজে। হজে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞাও।

ফলে লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দেওয়ার কথা বললেও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সারতে দেরি হচ্ছিল। তবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ছিল বলে প্রধানমন্ত্রী জানালেন।

“আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম ফাইল তৈরি করতে। কেবিনেট ডিভিশনে ফাইল তৈরি ছিল। কেবিনেট সেক্রেটারি কাল (শনিবার) হজ থেকে আসার পর তার সঙ্গে আমি বসেছি। কেবিনেট সেক্রেটারিসহ মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গেছি। তারপর উনি সেটা সই করে দিলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।”

রোববার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব সচিবালয়ে যান। এরপর তিনি এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান।   

মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী (শেখ হাসিনার বাঁয়ে আমির হোসেন আমুর পরের আসনে)

প্রজ্ঞাপন পড়ে শুনিয়ে তিনি বলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (১) দফার (গ) উপ-দফা অনুযায়ী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান হয়েছে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে।”

কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের ‘অবসান’ ঘটানো হলো- সে বিষয়টি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এর বাইরে কিছু বলেননি। 

আওয়ামী লীগ অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন।

সৈয়দ আশরাফ বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র, আদর্শ ও ঘোষণাপত্রের পরিপন্থি কাজ করার জন্য লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়ি গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক বসে।

ফলে মন্তব্যের ১৫ দিন পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই দুটি পদই হারান লতিফ সিদ্দিকী, আর তা ঘটেছে তার বিদেশে অবস্থানের মধ্যেই।

যুক্তরাষ্ট্রেই ঈদুল আজহা উদযাপন করা লতিফ সিদ্দিকী অবশ্য সমালোচনার মুখে বলেছিলেন, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলবেন, সে অনুযায়ীই কাজ করবেন তিনি। তবে মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাইবেন না তিনি।

এদিকে কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী অবশ্য বড় ভাইয়ের হয়ে ইতোমধ্যে ক্ষমা চেয়েছেন, যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।

তীর্যক বক্তব্য এবং আচরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসা লতিফ সিদ্দিকী তার ভাইকে নিয়ে কথা বলতেও ছাড় দেননি।

কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাৎ জামায়াত ঘনিষ্ঠতাকে’ তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন। আবার বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এই লতিফ সিদ্দিকীই ১৯৮০ এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ
করেছিলেন, আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তিনিই বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।

ষাটের দশকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিনগুলোতে একাধিকবার কারাগারে যেতে হয় বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য লতিফ সিদ্দিকীকে।

ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬ ছয় দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসাবেও ভূমিকা রাখেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমএনএ হয়েছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদে টাঙ্গাইল থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।  

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী নারী সাংসদ হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি।

গত সরকারের শুরুর দিকে এক অধিবেশনে সংসদের প্রথম সারিতে মন্ত্রী ও সরকারি দলের সাংসদের অনুপস্থিতি দেখে তখনকার স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ক্ষোভ প্রকাশ করলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই তার জবাব দেন লতিফ।

সংসদে তিনি বলেন, “স্পিকার হচ্ছেন সংসদের সেবক। তিনি প্রভু নন। কোনো সাংসদের পয়েন্ট অফ অর্ডারেই শুধু রুলিং দিতে পারেন স্পিকার।”

২০১১ সালে পাট নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘যথাযথ মর্যাদা’ না দেওয়ার অভিযোগ তুলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতেই আয়োজকদের তুলোধুনা করেন তখনকার পাটমন্ত্রী লতিফ।

বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, যে চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’