বিএনপির ভুল ধরিয়ে দিতে চেয়েছি: মওদুদ

সরকারের ‘মনরক্ষার জন্য’ নয়, ‘সংশোধনের’ জন্য নিজের লেখা সাম্প্রতিক বইয়ে বিএনপির ‘ব্যর্থতা ও ভুলগুলো’ তুলে ধরেছেন বলে মন্তব্য করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2014, 09:28 AM
Updated : 15 Sept 2014, 06:58 PM

দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সমালোচনার জবাবে মওদুদ বলেছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের ‘ওই ভুলগুলো’ সংশোধন করে নিলে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে তার বিশ্বাস। 

দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, বইতে ‘ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি’ প্রকাশ করেছেন  বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

সোমবার সুপ্রিম কোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাবেক চার দলীয় জোট সরকারের আইন মন্ত্রী মওদুদ বলেন, “সরকারের মন রক্ষা কিংবা বাড়ি রক্ষার সঙ্গে এই বইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বইতে ওই সময়ে আমাদের দলের নানা ব্যর্থতা ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের পরাজিত হওয়ার কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

“যেসব কারণ চিহ্নিত করেছি, আমি বিশ্বাস করি, তা সংশোধন করে আগামীতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা ক্ষমতায় ফিরে আসব। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে।”

ফাইল ছবি

‘অভিনন্দন’ আশা করেছিলেন মওদুদ

‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দি আফটারম্যাথ: ২০০৭-২০০৮’ শিরোনামে মওদুদের লেখা ওই বইয়ে চারদলীয় জোট সরকারের ‘অপশাসন’ ও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা, বিএনপি সরকারের কিছু মন্ত্রীর সম্পৃক্ততায় জঙ্গিবাদের উত্থান, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে ‘হাওয়া ভবনের দুর্নীতি’ এবং ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ‘বিতর্ক সমাধানে ব্যর্থ হয়ে’ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দায়িত্ব দেয়ায় মতো বিষয়গুলো এসেছে।

মওদুদের মতে, মূলত এসব কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা বিএনপির কাছ থেকে ‘মুখ ফিরিয়ে নেন’।

বিগত সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাবন্দি অবস্থায় ইংরেজিতে লেখা মওদুদের ওই বই গত শনিবার প্রকাশিত হলে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রিজভী সোমবার বলেন, “নিজের বাড়ি রক্ষার জন্য, নাকি ক্ষমতাসীন দলের মন রক্ষার জন্য এরকম ভাষ্য তিনি দিয়েছেন তা জানি না। আমি মনে করি তার এহেন ভাষ্য দুর্ভাগ্যজনক।”

এর জবাবে মওদুদ বলেন, “বইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে রিজভীর মন্তব্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তার মন্তব্য শুনে আমি দুঃখ পেয়েছি। বইটি পুরোপুরি পড়ে মন্তব্য করা উচিৎ ছিল। এরকম মন্তব্য তার কাছে থেকে আমি আশা করিনি।”

নিজের লেখা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা বলেন, “এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য ২০০৮ সালের নির্বাচন।…  ক্ষমতায় থাকাকালে আমাদের দলের ব্যর্থতা ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার অনেক কারণ ছিল। তা আমি উল্লেখ করেছি বইতে।”

বইয়ের একটি অধ্যায়ে ওই নির্বাচনের ফলকে ‘নীরব বিপ্লব’ এর সঙ্গে তুলনা করেন মওদুদ, যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। 

এই বিএনপি নেতার মতে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ও জঙ্গিবাদের বিপক্ষে’ শেখ হাসিনার অবস্থান এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে তার ‘পরিবর্তনের আহ্বানে’ দেড় কোটি তরুণ ভোটারের ‘দৃষ্টি আকৃষ্ট’ হয়।

পাশাপাশি ১০ টাকায় চাল, বিনামূল্যে সার, প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে ‘উদ্বুদ্ধ করে’। এসব ‘ইতিবাচক’ বিষয়ের পাশাপাশি বিএনপির বিপক্ষে নেতিবাচক ভোটও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে এগিয়ে নেয় বলে মনে করেন মওদুদ।

অবশ্য রিজভীর সমালোচনার পর তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ওই নির্বাচন ‘সুষ্ঠু হয়নি’। সেদিন ১ লাখ ৭১ হাজার কেন্দ্রে “প্রতি এক মিনিটে একটি করে ভোট পড়ে, যা অবিশ্বাস্য।”

মওদুদ বলেন, “২০০৭-০৮ সালে কীভাবে ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দীন সরকার রাজনীতিবিদদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, কী করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে আমাদের দলকে দুর্বল করতে নানা ষড়যন্ত্র করেছিল, ওই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহযোগিতায় কীভাবে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় এসেছে-ইত্যাদি বিষয়গুলো আমি তুলে ধরেছি।”

রিজভীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এই বিএনপি নেতা বলেন, “এই বই লেখার পর আমার ভয় ছিল- সরকার অসন্তুষ্ট হবে। আমাকে কারাগারে যেতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি আমার দলের ভেতরে এক সহকর্মী অসন্তুষ্ট। তিনি বইটি না পড়ে মন্তব্য করেছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হেডিং ও প্রতিবেদন দেখে তার মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি। আমি তাকে খুব স্নেহ করি।”

রিজভী বইটি পড়ে অভিনন্দন জানাবে- এমন আশাও করেছিলেন বলে জানান মওদুদ।

‘বাড়ির সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক নেই’

সরকারের মন রাখতে ওই বই লেখা হয়েছে- রিজভীর এমন মন্তব্যের জবাবে মওদুদ বলেন, “প্রশ্নই ওঠে না। আমার বিরুদ্ধে এখনো ১৮টি মামলা রয়েছে। বাড়ি রক্ষার যে কথা রিজভী বলেছে, তা ঠিক নয়। বাড়িটি (গুলশান) আমার খরিদ করা। সরকার জোর করে ওই বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করতে ষড়যন্ত্র করছে।”

অবৈধভাবে বাড়ি দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাই মনজুর আহমদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক, যেটি ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ আদালতে বিচারাধীন।

ওই মামলায় দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করে রোববার মনজুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

ওই বাড়ির বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা রয়েছে জানিয়ে মওদুদ বলেন, “এটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। আমি মনে করি, ন্যায় বিচার হলে আমার খরিদ করা বাড়ি থেকে কেউ আমাকে বের করে দিতে পারবে না।”

বাড়ির সঙ্গে বইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে তিনি বলেন, “বইটি লেখার সময়কাল ২০০৭-০৮ সালে। আমি কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বইটি লেখেছি। আর বাড়ির মামলা দুই বছর আগের। এর সঙ্গে বইয়ের কোনো সর্ম্পক নেই।”

‘এ বই ভবিষ্যতের জন্য’

এক প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেন, “দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, ওই বইতে আমি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছি, যতটুকু সম্ভব বস্তুনিষ্ঠভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছি। কারণ বই বর্তমানের জন্য লেখা নয়, এটা ভবিষ্যতের জন্য।”

মওদুদের এই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মওদুদ বলেন, “তিনি একজন শিক্ষক। কখনোই তিনি কড়া কথা বলেন না। শুনেছি ২/৩ আগে এক টকশোতে তিনি নাকি সরকারের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলেছেন। সে কারণে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করছি।”

মুক্তিযুদ্ধের উপ অধিনায়ক একে খন্দকারের বই ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরূপ মন্তব্যেরও সমালোচনা করেন মওদুদ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “উনি তার মত প্রকাশ করেছেন। গণতন্ত্র বিশ্বাস করলে কেন তিনি স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবেন না? এটা ঠিক নয়।”