নির্বাচন অনেক আগেই দিতে হবে: ফখরুল

সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে নমনীয় কর্মসূচি দেয়ার পর বিএনপি এখন বলছে, ২০১৯ সালের ‘অনেক আগেই’ সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2014, 09:20 AM
Updated : 20 August 2014, 01:32 PM

দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “সরকার যত কথাই বলুক না কেন, তাদের সংলাপে বসতেই হবে। ২০১৯ সালের অনেক আগেই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে, সেখানে সব দল অংশ নিতে পারে।”

বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মির্জা ফখরুল। বিভিন্ন বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

ফখরুল বলেন, “৫ জানুয়ারি ভোটবিহীন নির্বাচন করে সরকার ভাবছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তারা অবৈধভাবে দেশ পরিচালনা করবে। তারা একেবারেই ভুলের স্বর্গে বাস করছে। জনগণ ওই নির্বাচন মেনে নেয়নি। বিশ্ববাসীও সমর্থন করেনি।”

৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি জোট নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে তা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলার পাশাপাশি বলছেন, এই মুহূর্তে কোনো ধরনের আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেবে না।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা ঈদের পর সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলে আওয়ামী লীগের নেতারাও মাঠে থাকার পাল্টা ঘোষণা দেন। ঈদের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কিছুটা নমনীয় সুরে বলেন- আন্দোলন হবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে।  

এরপর গত ১২ অগাস্ট বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ১৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাতে মিছিল, সমাবেশ ও গণসংযোগের বাইরে কোনো জোরালো কর্মসূচি রাখা হয়নি। 

এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেন, “গাড়ি যেমন প্রথমে ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড গিয়ার দিয়ে গতি বাড়াতে হয়, তেমনি আন্দোলনও সেভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। আমরা বিশ্বাস করি, দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে জনগণ যতো দ্রুত রাজপথে নেমে আসবে, ততো দ্রুত আন্দোলন টপ গিয়ারে উঠবে।”

রাজধানীর সেগুন বাগিচায় রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এই মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত ১৭ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও এ রকম একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিএনপির মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেন।

এরপর প্রায় এক ঘণ্টা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলনের কর্মকৌশল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা বিভিন্ন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন তিনি।

‘কিছুদিনের বিরতি’

মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকার যেভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, তাতে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প পথ খোলা নেই। ৫ জানুয়ারির একতরফা তামাশার নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনের পর আমরা কিছুদিন বিরতিতে ছিলাম। আবার আমাদের আন্দোলন শুরু করতে হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, আন্দোলন ছাড়া গণতন্ত্র ফিরে আসবে না।”

বিএনপির ভোট বর্জনের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলেও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মনে করেন না। 

তিনি বলেন, “দেশের ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি ওই নির্বাচন বর্জন করেছে।… ওই নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে জনপ্রতিনিধিত্ব নেই।”

এবারের আন্দোলনের ধরন কেমন হবে জানতে চইলে ফখরুল বলেন, দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত সারাদেশে যে গণসংযোগ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে তা শেষ হলে নতুন কর্মসূচি আসবে।

‘পাকিস্তানের নজির’

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা জামায়াতে ইসলামী জোটসঙ্গী হওয়ায় ক্ষমতাসীনরা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে চায় না- এক সাংবাদিকের এমন মন্তব্যের জবাবে ফখরুল বলেন, “আগেও সরকার এরকম অজুহাত তুলেছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও আমাদের সঙ্গে তারা দুইবার সংলাপ করেছিল।”

তার ভাষায়, জনসমর্থন হারিয়ে সরকার এখন ‘চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে’। ক্ষমতাসীনদের কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। তাদের সংলাপে আসতেই হবে।

“পাকিস্তানের অবস্থা দেখুন। সেখানে সরকার টিম পাঠিয়ে সংলাপ করতে চাইছে। যে কোনো রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।”

সরকারকে সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, “আমরা রাস্তায় নামতে চাই না, আন্দোলনও চাই না। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করুন। এজন্য সংলাপ করতে হবে। এই সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।”

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারাংকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপে কী আলোচনা হয়েছিল জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “ওই সংলাপে বলা হয়েছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করতে হবে। এরপর আবার সংলাপ করে নির্বাচন হবে। এর কোনো ডকুমেন্টস নেই। আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে ডকুমেন্টস হয় না।”

“তবে সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, সাংবিধানিক কারণে নির্বাচন করতে হচ্ছে, পরে সংলাপ করে আবার নির্বাচন হবে।”

ফখরুল অভিযোগ করেন, বিএনপি সব সময় সংলাপ চাইলেও সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে ‘কলা কৌশল করে’ ক্ষমতায় থাকতে চাইছে।

‘সবচেয়ে পরীক্ষিত নেত্রী’

মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০ দলের সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত না থাকায় সমালোচনা হচ্ছে জানিয়ে একজন সাংবাদিক জানতে চান, বিএনপি প্রধানের এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য আছে কিনা।

জবাবে ফখরুল বলেন, “দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলন-সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত নেত্রী। নয় বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি আপোষহীন ভূমিকা রেখেছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তিনি আপস করেননি। সেনা সমর্থিত সরকারকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিলেন। তার মতো একজন নেত্রী সর্ম্পকে এরকম কথা ঠিক নয়।”

সমাবেশে খালেদার যোগ না দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিএনপির মুখপাত্র বলেন, “যে কেউ অসুস্থ হতেই পারেন। আমি আজ ঠাণ্ডা-কাশি নিয়ে এখানে এসেছি। নেত্রী শারীরিক অসুস্থতার কারণে আসেননি। গতকালের (মঙ্গলবার) মতো অবস্থা সব সময় নাও হতে পারে।”

সম্প্রচার নীতি

অহিংস আন্দোলনে সরকার পতন সম্ভব কিনা জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “আমরা সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করি না। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। গত আন্দোলনে সরকারের বাহিনী সহিংসতা করেছে। তাদের (সরকার) নানা চাপের কারণে মিডিয়াগুলো ওই সব ঘটনাকে বিএনপির সহিংসতা বলে চালিয়ে দিয়েছে।”

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আজ এমন সব আইন করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।”

বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে এই নীতিমালায় পরিবর্তন আনবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন ফখরুল।

তিনি বলেন, “ইনকিলাবের বার্তা সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এহেন কর্মকাণ্ড মুক্ত তথ্য প্রবাহের প্রধান অন্তরায় বলে আমরা মনে করি।”

অভিশংসন ক্ষমতা

সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগেরও সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, “এটা গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক। নিজেদের সুবিধার জন্য সংবিধান কেটে-ছেঁটে ফেলা ঠিক নয়। এর উদ্দেশ্য একটাই- কোনো বিচারক যেন সরকারের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে… অর্থাৎ, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করা।”

তিনি মনে করিয়ে দেন, পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকও বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে বাতিল করতে বলেননি।

“১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। এরপর চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে ওই ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ওই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এখন জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করে, এটা ঠিক নয়।”

ফখরুলের দাবি, রাষ্ট্রপতি জিয়া প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আরো দুই বিচারককে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়টির ‘সমাধান’ করেছিলেন।

‘ঐক্য অটুট’

২০ দলীয় জোটে বিভাজন নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দাবি করেন, জোটে ঐক্য অটুট।

“একটি নির্দিষ্ট দলের নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে। ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপির নিলু ( শেখ শওকত হোসেন নিলু) সাহেবকে বহিষ্কার করে তার জায়গায় ফরহাদ সাহেবকে( ফরিদুজ্জামান ফরহাদ) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের সঙ্গেই আছেন।”

অন্যদের মধ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম, অর্থ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মুরসালিন নোমানী  মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।