খালেদার প্রত্যাখ্যানেও আশাবাদী হাসিনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরল এক ঘটনার জন্ম দিয়ে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ‘দুঃখ’ পেলেও বিরোধী দলের অবস্থান বদলাবে বলে আশা করছেন শেখ হাসিনা।

মুনীরুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2013, 04:54 PM
Updated : 26 Oct 2013, 05:04 PM

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কায় দেশবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বিরোধীদলীয় নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় তাকে টেলিফোন করেন প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হরতাল প্রত্যাহার করে আলোচনার জন্য বিএনপি চেয়ারপাসনকে গণভবনে সোমবার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান।

কিন্তু জোটের ডাকা হরতাল প্রত্যাহার এই মুহূর্তে সম্ভবপর নয় জানিয়ে খালেদা জিয়া সোমবার বৈঠকে যাওয়ার প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি।

অনিশ্চয়তার মধ্যে দুই নেত্রীর এই সংলাপ আশা জাগালেও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল বলে মনে করেন প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক।

৬০ ঘণ্টার হরতালের আগের দিন রাজধানীজুড়ে বোমাবাজি ও গাড়ি পোড়ানোর মধ্যে সংলাপে ঢুকেও বিএনপির এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছেন দুই প্রধান জোটের বাইরে থাকা দল সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

হরতাল বহাল থাকায় হতাশা প্রকাশ করে রাজধানীর বেসরকারি চাকরিজীবী তন্ময় দেবনাথ বলেন, “তারপরও আশা করছি, দেশের মানুষের স্বার্থে দুই নেত্রী সমঝোতার দিকে এগোবে এবং সব দল মিলিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে।”

বেশ নাটকীয়তার মধ্যে এক সপ্তাহ আগে দুই প্রধান দলের মুখপাত্রদের টেলিফোনে আলোচনার পর এবার কথা বললেন দল দুটির প্রধান নেত্রীরা।

এই আলোচনার সাক্ষী সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একে অভিহিত করেছেন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘যুগান্তকারী’ ঘটনা হিসেবে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে থাকা তার প্রেসসচিব বলেছেন ‘শুভ সূচনা’।

টেলিফোনে কথায় দুই নেত্রী আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের কথা বললেও পরে বিরোধীদলীয় নেতার প্রেসসচিব জানান,হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভবপর হচ্ছে না এবং  হরতালের মধ্যে সোমবার গণভবনের আমন্ত্রণও রক্ষা করতে পারছেন না তারা।

তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ‘উদ্বিগ্ন’ হলেও শেখ হাসিনা আশা করছেন, বিরোধী দল সংলাপে আসবে এবং হরতাল প্রত্যাহার করে নেবে।

বিএনপির বক্তব্যের পর শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী দুঃখ পেয়েছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

“তারপরও তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী নৈশভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন, হরতাল প্রত্যাহার করবেন।”

নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গত ১৮ অক্টোবর দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই প্রস্তাব গ্রহণ না করে বিএনপি চেয়ারপারসন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা দিয়ে তা নিয়ে আলোচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আলোচনার জন্য চিঠি পাঠানোর পর দশম সংসদ নির্বাচনের দিন গণনার শুরুতে শুক্রবার জনসভায় বক্তব্যে সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন বিরোধী নেত্রী। এর একদিন বাদেই প্রধানমন্ত্রীর ফোন পান তিনি।

ইকবাল সোবহান বলেন, “তিনি (খালেদা জিয়া) সংলাপ চেয়েছিলেন। আলটিমেটামের আগেই বিরোধীদলীয় নেতাকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

“আশা করি, বিরোধী দল ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়ে হরতাল প্রত্যাহার করবে।যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাই হরতালের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।”

শেখ হাসিনা টেলিফোনে খালেদা জিয়াকে বলেন, “২৮ তারিখ রাতে খাওয়ার জন্য আপনাকে দাওয়াত করছি। যতজন খুশি নিয়ে আসতে পারেন। আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি আগামী নির্বাচন সম্পর্কে গণভবনে আসার জন্য।”

“আপনি হরতাল প্রত্যাহার করে নেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করেন,”

হরতালের কর্মসূচি ১৮ দলের জানিয়ে জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, “আপনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি এই টেলিফোনটি গতকাল (শুক্রবার) করতেন, তাহলে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। এখন আমার একার পক্ষে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার সম্ভব নয়।

“২৯ অক্টোবর সন্ধ্যার পর যে কোনো সময়ে আলোচনার জন্য আপনি ডাকলে তাতে আমি সাড়া দেব।”

বিএনপির সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “খালেদা জিয়া নিজের অবস্থানে রয়ে গেলেন। তিনি আলোচনায় না গিয়ে সংঘাতের পথে যাচ্ছেন।”

শেখ হাসিনা যে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করছেন, তা শুক্রবার জনসভায় হরতালের ঘোষণার আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। শনিবার মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানান, সন্ধ্যায় যাচ্ছে সেই টেলিফোন।

সুরঞ্জিতের ওই বক্তব্য নিয়ে তার দলের সমালোচনার মধ্যেই খবর আসে, শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে নিজেই টেলিফোন করেছেন খালেদা জিয়াকে, তবে কথা বলতে পারেননি।

বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস পরে সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়ির টেলিফোনটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে আছে।

এরপর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর এডিসি ফোন করেন শিমুল বিশ্বাসকে। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার এই দুই সহকারীর মোবাইল ফোনই বিরল এই সংলাপের সাক্ষী হল। 

সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের পাশাপাশি ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানও।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ না করে জনগণের স্বার্থের প্রতি উদাসীনতা দেখালেন বিরোধী নেত্রী।

খালেদা জিয়া তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বলেছেন, “আপনি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব দিয়েছি। এই দুটি প্রস্তাব সমন্বয় করে সমঝোতা হতে পারে বলে আমি মনে করি।

“গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলনে আমরা অতীতে একসঙ্গে কাজ করেছি। আপনার (শেখ হাসিনা) বাসায় গেছি। আজ  জাতির সঙ্কট মুহূর্তে জাতীয় ইস্যুতে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই।”

আকবর আলি খানও আশাবাদী, ছাড় দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত দেশের স্বার্থে একটি সমঝোতায় পৌঁছাবেন দুই নেত্রী।

বার্ষিক পরীক্ষার আগে রাজধানীর নবম শ্রেণির ছাত্রী নম্রতা সরকার আনুশকার মতো অন্য শিক্ষার্থীরাও ভাবছেন, তাদের ‘টেনশনমুক্তি’ দেবেন দুই নেত্রী।