সংলাপের কথকতা

আগেকার সব সংলাপ ব্যর্থ হলেও দেশ রাজনৈতিক সঙ্কটের দ্বারে থাকা অবস্থায় আবার একটি সংলাপ আয়োজনের ইঙ্গিত মিলছে, যাতে সফলতা চাওয়া হচ্ছে সব মহল থেকে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2013, 07:33 PM
Updated : 24 Oct 2013, 11:15 AM

আগামী নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থায় মঙ্গলবার সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আর এর মধ্য দিয়ে সংলাপের সুর বেজে উঠল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যা চেয়ে আসছিলেন কূটনীতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও।

আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই নেত্রী দুই রকম প্রস্তাব দিলেও তার মধ্যদিয়েই সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে বলে সোমবারই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা।

মঙ্গলবার বিএনপির মুখপাত্রের চিঠির পর তার আশাবাদ আরো দৃঢ় হয়েছে যে সংলাপের মধ্য দিয়ে মতপার্থক্যের অবসান ঘটবে। 

দেশের সাধারণ মানুষের একজন এনজিওকর্মী মরিয়মনেসা মুন্নিও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলেই দেশে শান্তি আসবে।”

তবে এই মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় নিকট অতীতে দুই বার সংলাপে বসতে দুই দলের নেতাদের দেখেছে দেশের মানুষ। কিন্তু ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের আগে তার কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি।

তাই সমঝোতার জন্য ছাড় দেয়ার মনোভাব না দেখালে নতুন করে সংলাপের এই আয়োজনের সফলতা নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী।

তবে তারপরও আশাবাদী সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি ১৯৯৬ সালের আগে কমনওয়েলথের উদ্যোগে নিনিয়ান স্টেফানের মধ্যস্থতায় সংলাপে সম্পৃক্ত ছিলেন।

সেটাই ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক প্রধান সংলাপ। তখনো নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

তখন কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত স্যার নিনিয়ান দুই প্রধান দলকে মানাতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব ঘটে।

তার পাঁচ বছর পর ২০০৬ সালে নির্বাচনের আগে আবার মুখোমুখি অবস্থানে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে সংলাপে বসেছিলেন তখন ক্ষমতাসীন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া।

বর্তমানে প্রয়াত এই দুই নেতা দেশের মানুষকে আশায় রেখে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে গেলেও সমঝোতার কোনো খবর দিতে পারেননি।

আর তারপর রাজনৈতিক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করে দেশে আসে জরুরি অবস্থা, দুই বছর দেশ থাকে কার্যত সেনা শাসনে।

সংলাপের ওই অভিজ্ঞতায় মিজানুর রহমান শেলী এবারো আশাবাদী হতে পারছেন না।

“নতুন করে সংলাপের ‘মহড়া’ চলছে। এটি ঐতিহাসিক মোড় নেবে, তেমন উৎসাহ বোধ করছি না,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।

তার মতে, শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে ন্যুনতম ছাড় দেয়ার প্রবণতা না থাকলে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনবে না।

“এ পর্যন্ত সব সংলাপ অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তার সমাধান হয়েছে রাজপথে, তীব্র আন্দোলনে,” বলেন এরশাদ আমলের এই মন্ত্রী।

তবে প্রবীণ রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে, ওই সময়ের অবস্থান ও আজকের প্রেক্ষাপট এক নয়। এর সঙ্গে পারস্পরিক তুলনা চলে না।

“দুই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থান একেবারেই ভিন্নতর। এখন গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।

সংলাপের এবারের উদ্যোগকে ‘ইতিবাচক’ উল্লেখ করে এর মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ সমাধান আসবে বলে মনে করেন সুরঞ্জিত।

“সাংবিধানিক কাঠামোর মধে থেকেই সমাধান আসবে। এক্ষেত্রে সদিচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে।”

এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংলাপের কথা তুলে ধরে মিজানুর রহমান ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মহাত্মা গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর গোলটেবিল আলোচনার কথা তুলে ধরেন।

পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬৮-৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-আইয়ুব খানও পিণ্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক করেছিলেন।

মিজানুর রহমান বলেন, “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ভিত্তি নির্মূলে এ সংক্রান্ত আইন প্রত্যাহারে এ সংলাপ হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গোলটেবিলে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।”

তবে আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছিল এবং এর সশস্ত্র সংগ্রামে অভ্যূদয় ঘটে বাংলাদেশের।

স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের আমলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে ১৯৮৬ সালের দিকে সংবিধান সম্মতভাবে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা চলে।

মিজানুর রহমান বলেন, “তাতে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়।”

১৯৯০-এর ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা চলেছিল।

তবে ১৯৯৬ সালের পর আনুষ্ঠানিক সংলাপ ছিল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়ার আলোচনাই।

এবার সংলাপের তাগিদ আসে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের তরফ থেকেও। কিছুদিন আগেই দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন তিনি।

তার আগে গত মে মাসে বাংলাদেশে দূত হিসেবে পাঠান সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। তিনি দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে দ্রুত সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়ে যান।

তার কয়েকমাস পর গত শুক্রবার নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তার তিন দিন পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তুলে ধরে তার ভিত্তিতে সংলাপের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

এর একদিন বাদেই সংলাপের চিঠি দেখল দেশবাসী। শুধু তাই নয়, দুই প্রধান দলের মুখপাত্রকে টেলিফোনে কথাও বলতে দেখা গেল।

এই ঘটনায় আশাবাদী নির্বাচন কমিশনও, যারা আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবে।

“কিছুটা হলেও বরফ গলছে। ভালো কিছু আশা করছি আমরা,” বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।