নিবন্ধন অবৈধ, নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ জামায়াত

সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2013, 08:42 AM
Updated : 5 August 2013, 09:04 AM

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হয়ে ওঠার মধ্যেই বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ের ফলে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী।

অবশ্য রায়ের পরপরই চেম্বার জজের কাছে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল জমা দিয়েছেন জামায়াতের আইনজীবী। তার দাবি, ‘জামায়াত নির্বাচন করতে পারবে না’- এ কথা এখনই বলা যাবে না।

রায় প্রত্যাখ্যান করে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটি একটি ‘ভুল’ রায়। এ রায়ের মাধ্যমে সরকারের ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের’ প্রতিফলন ঘটেছে।

রায়ের প্রতিবাদে ঈদের পর টানা দুদিনের হরতালও দিয়েছে দলটি। দলের বিক্ষুব্ধ নেতারা বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও গাড়িতে আগুনও দিয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রায়কে জামায়াত নিষিদ্ধ করার যুক্তি হিসেবে দেখছে। জামায়াতের প্রধান মিত্র বিরোধী দল বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। আর অবিলম্বে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে বামপন্থী দলগুলো।

সংক্ষিপ্ত রায়ে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, “বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেইড অ্যাবসলিউট অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লেয়ার্ড ইলিগ্যাল অ্যান্ড ভয়েড।”

রায়ের বিস্তারিত পরে প্রকাশ করা হবে বলেও আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

মামলার ইতিবৃত্ত

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই বিগত নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়।

জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি রিট আবেদন করে।

তাতে বলা হয়, চার কারণে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন পেতে পারে না।

প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না।

দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।

তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।

চতুর্থত, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে- তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।

ওই রিটের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট একটি রুল জারি করে।

রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি(১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।

পরে রুলটি বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে যায়। সেখানে আংশিক শুনানির মধ্যেই ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়। এরপর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে রিটের শুনানি শেষ হয় গত ১২ জুন।

এরই মধ্যে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে জামায়াত। গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসুল প্রদর্শিত’ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়।

এক নজরে জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি রায়েই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।

১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন।

সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা।

সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী।

প্রতিক্রিয়া

আলোচিত এ রায় উপলক্ষে আগেই হাই কোর্ট এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সংবাদকর্মী ও আইনজীবীরা রায় শুনতে জড়ো হন এজলাসে।

রায়ের পর নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ের ফলে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।”

রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজুও আদালতে উপস্থিত ছিলেন ।

অন্যদিকে জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এটি একটি বিভক্ত রায়। রায়ের পর বিচারকরা ঐকমত্যে সরাসরি আপিলের অনুমতি দিয়েছেন। ওই রায় স্থগিতের জন্য আমরা আপিলও ফাইল করেছি।… তাই বলা যায়, বর্তমান অবস্থায়ও জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। রায় স্থগিত হলেতো পারবেই।”

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ ইসি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের আদেশ শিরোধার্য। রায়ের কপি হাতে পেলেই আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।”

পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের কপি হাতে পেয়ে তারা ‘দ্রুত’ ব্যবস্থা নেবেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এখন থেকে জামায়াত রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হবে।

সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, বামমোর্চাসহ বাম দলগুলো রায়কে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এখন যতো দ্রুত সম্ভব, জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ‘সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’ করা উচিত।

আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামও মনে করছেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের রায় দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের ‘আইনি প্রক্রিয়ায় শক্ত ভিত্তি’ হিসেবে কাজ করবে।

জামায়াতের শরিক দল বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এ রায় দিয়ে হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। কারণ ইসি জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসির নিবন্ধন বাতিল করায় ইসির অক্ষমতারই প্রকাশ ঘটেছে।

এছাড়া আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে তার পাশেই ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া।