নির্বাচনকালীন সরকারের ‘রূপরেখা’ প্রস্তাব টিআইবির

সংসদীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে- টিআইবি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2013, 02:41 AM
Updated : 12 April 2013, 07:07 AM

প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক জোটের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি’ হবে। এই কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানসহ ১১ সদস্যের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা মনোনীত করবে।

এ সরকারের মেয়াদ হবে দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত এই সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে রূপরেখায় সুপারিশ করা হয়েছে।

শুক্রবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে সংবাদ সম্মেলন করে ‘বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা: প্রক্রিয়া ও কাঠামো প্রক্রিয়া’ শিরোনামে এই রূপরেখাটি তুলে ধরে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি।

একটি ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য বর্তমান ‘সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে’ সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনার জন্য এই প্রস্তাব রাখা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।  

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জ্মান জানান, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সবগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে টিআইবির এই রূপরেখা পাঠানো হবে।

রূপরেখায় বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো সদস্য দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না এবং দশম সংসদে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ওই সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত সরকারি কোনো লাভজনক পদে থাকতে পাবরেন না।

নির্বাচনকালীন এই সরকার নির্বাচন কমিশনের প্রতি সব দলের আস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।

প্রস্তাবিত এই নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো ও প্রক্রিয়া গৃহীত হলে দশম সংসদ নির্বাচনসহ পরবর্তী নির্বাচনে তা কার্যকর করার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করার কথাও রূপরেখায় বলা হয়েছে।

এক্ষেত্রে গণভোটের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করে টিআইবি।

রূপরেখা প্রণয়নের কারণ হিসাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জান বলেন, “দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে মনে করছি এই প্রক্রিয়াকে (নির্বাচন) গণতান্ত্রিক করার জন্য আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া প্রয়োজন।”

টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুলতানা কামাল ও সদস্য হাফিজউদ্দিন খানও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পর থেকেই বিএনপি সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।  

এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য অবসানে কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি সংলাপে তার দলের অনাপত্তির কথা জানান। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর কথা বলেন।

এই পরিস্থিতিতে এক আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে একটি রুল জারি করে উচ্চ আদালত।

অবাধ ও স্বচ্ছভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে সংসদের ভিতরে-বাইরে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে এই রুলে।

চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট অবসানে একসঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে চিঠি পাঠিয়েছেন সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও।

টিআইবির প্রস্তবে বলা হয়, পারস্পারিক আলোচনার ভিত্তিতে উভয় জোট থেকে সমান সংখ্যক (৪-৬ বা উভয় জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য সংখ্যক) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে ‘সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি’ গঠিত হবে। এই কমিটি গঠনের আহ্বান জানাবেন স্পিকার। পরে রাজনৈতিক দলগুলো কমিটির সদস্য মনোনয়ন দেবে এবং স্পিকার ওই কমিটির সভা ডাকবেন।

জাতীয় সংসদ সচিবলয়ের সচিব এই কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানসহ ১১ সদস্যের তালিকা প্রস্তুত করবে। তারা উভয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য একজন নির্বাচিত বা অনির্বাচিত ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসাবে মনোনীত করবেন।

তবে ১১ সদস্যের নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে দুটি বিকল্প প্রস্তাবও রাখা হয়েছে টিআইবির রূপরেখায়।

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, ঐকমত্য কমিটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান মনোনয়ন দেবে। পরে সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের ১০ সদস্যের তালিকা করা হবে।

দ্বিতীয় প্রস্তবে বলা হয়, ঐকমত্য কমিটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার ১০ সদস্যের তালিকা করবে। পরে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার প্রধান মনোনয়ন করা হবে।

রূপরেখায় বলা হয়েছে, সরকার প্রধান মনোনয়ের ক্ষেত্রে কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে অনধিক তিন ব্যক্তির একটি তালিকা স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে। ওই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে সরকার প্রধান হিসাবে মনোনয়ন দেবেন।

নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার ১০ সদস্য মনোনয়নেও তিনটি বিকল্প প্রস্তাব রেখেছে টিআইবি। এতে বলা হয়েছে, উভয় জোট থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও অনির্বাচিত/নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে অথবা শুধু অনির্বাচিত/নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এই মন্ত্রিসভা করা যেতে পারে।

এছাড়া মন্ত্রিসভার ১০ সদস্যের তালিকা প্রণয়নে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের দলীয় অনুপাতের ভিত্তিতে সদস্য মনোনীত করা যেতে পারে বলেও রূপরেখায় বলা হয়েছে। এক্ষেত্রেও তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে।

রূপরেখায় বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদপূর্তির ৩০ দিন আগে এই নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্যদের তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি এই নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।

সংসদীয় ঐকমত্য কমিটির সার্বিক সমন্বয় ও জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের জন্য দুইজন যুগ্ম আহ্বায়ক থাকবেন যারা কমিটির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি অকার্যকর হয়ে যাবে।

কমিটির সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে আহ্বায়কদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সভার সভাপতি নির্ধারিত হবেন।

সংবাদ সম্মেলনে রূপরেখা উপস্থাপনের সময় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন ধারণা-ধরন, অন্য দেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়।

এছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সরকারি এবং বিরোধী দলের অবস্থান, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জগুলো’ তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।