‘গণহত্যার’ বিচার হবে: খালেদা

যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডবের ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় গেলে তার বিচারের ঘোষণা দিয়েছেন খালেদা জিয়া।

প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2013, 05:08 AM
Updated : 13 March 2013, 09:33 AM

পুলিশি অভিযান ও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের দুই দিন পর বুধবার নয়া পল্টনে দলের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সমবেত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্যে এই ঘোষণা দেন তিনি।

আটক দলীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে আগামী ১৮ ও ১৯ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল বহাল রাখার ঘোষণাও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের সমালোচনাও করেন তিনি।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি মেনে নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিরোধীদলীয় নেতা।

নয়া পল্টনের কার্যালয়ে ২৩ মাস পর দলীয় চেয়ারপারসনকে পেয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উল্লাস ছিল দেখার মতো। মুহুর্মুহু করতালি আর স্লোগানে দলীয় প্রধানকে স্বাগত জানান তারা।

অন্যদিনগুলোতে দেখা যায় না, কেন্দ্রীয় এমন অনেক নেতাকেও এদিন দেখা গেছে দলীয় কার্যালয়ে।

নেতাপরিবেষ্টিত খালেদা জিয়া কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, “পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত ১৭০ জনকে তারা হত্যা করেছে। এভাবে গণহত্যা তারা চালিয়েছে।

“প্রধানমন্ত্রী নিজেও এর দায় এড়াতে পারে না। এই গণহত্যার জন্য আবার বিচার হবে, এজন্য ট্রাইব্যুনাল হবে।”

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের পর জামায়াত বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে সরকারি হিসেবে ৬৭ জন নিহত হয়, এর মধ্যে সাতজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

যে সব পুলিশ সদস্য গুলি চালিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তাদের বিচারও করার ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, “সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন নেই। দেশের অর্থনীতিকে তারা পঙ্গু করে দিয়েছে। হল-মার্ক, ডেসটিনি, পুঁজিবাজার, পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারিরর ঘটনাসহ সব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে এখন মানুষ হত্যা করছে তারা।”

সরকার পতনের আন্দোলনে নামতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিরোধী নেতা বলেন, “এই সরকারকে আর সময় দেয়া যায় না।”

এই পর্যায়ে সমবেত কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা কি এই সরকারের বিদায় চান?”

উপস্থিত হাজার হাজার কর্মী হাত উঁচু করে দলীয় প্রধানের কথার জবাব দেন।

সরকার পতনে আগামীতে আরো কঠোর কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিতে কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এরপর হরতাল-অবরোধসহ আরো কঠিন কর্মসূচি হবে। তখন আপনারা (সরকার) পালাবার পথ পাবেন না।”

সরকারের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এখনো সময় আছে, আপনাদের বোধদয় হোক।

“নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। নইলে দেশের জনগণ আপনাদেরকে জোর করে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবে।”

গণজাগরণ মঞ্চের সমালোচনা

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের দিকে ইঙ্গিত করে খালেদা বলেন, “সরকার একদিকে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করছে, অন্যদিকে ‘বিধর্মী-নাস্তিকদের’ পাহারা দিয়ে নাস্তা-হালুয়া দিয়ে লালন-পালন করছে।

“এইসব মঞ্চ-ফঞ্চ বন্ধ না হলে জনগণের মঞ্চ তৈরি হবে।”

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ‘আন্তর্জাতিক মান’ বজায় রেখে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

“আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তা হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের। ক্ষমতায় গেলে সে বিচার আমরা করব।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই রাজাকার, আওয়ামী লীগেও বহু রাজাকার আছে, তাদের ধরতে হবে।

“আওয়ামী লীগের ‘এক’ নম্বর থেকে সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।”

জামায়াতি তাণ্ডবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হওয়ার জন্য সরকারকেই দায়ী করেন বিরোধী নেতা।

“সরকার নিজেরাই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে এর দোষ বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা করছে।”

“আমি বলতে চাই, এ দেশ সবার। আমাদের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন সংখ্যালঘুদের পাশে থাকে।”

“আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলব, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে ছিলাম। এখনো আছি, আগামীতেও থাকব।”

দলীয় কার্যালয়ের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে সমবেত কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন খালেদা।

নেতাদের ভিড়

খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বিএনপি কার্যালয়ে এদিন দলীয় নেতাদের ভিড় জমে।

বক্তব্য দেয়ার সময় তার পাশে ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ওসমান ফারুক, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, মুশফিকুর রহমান, মাহমুদুল হাসান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, রুহুল আলম চৌধুরী, হারুন অর রশীদ, শামসুজ্জামান দুদু, আবদুল হালিম, আবদুল মান্নান, আহমেদ আজম খান, জয়নুল আবেদিন, সালাহউদ্দিন আহমেদ।

এছাড়াও ছিলেন ফজলুল হক মিলন, গোলাম আকবর খন্দকার, মশিউর রহমান, আসাদুল হাবিব দুলু, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, নিতাই রায় চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, নাসির উদ্দিন অসীম, খায়রুল কবীর খোকন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করিম শাহিন প্রমুখ।

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী, মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরানসহ ১৮ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতাও এসসময় বিএনপি কার্যালয়ে ছিলেন।

খালেদা জিয়া বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কার্যালয়ে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। 

পুলিশি অভিযানের সময় ভাংচুর হওয়া মহাসচিবের কক্ষ এবং দপ্তর কার্যালয় ঘুরে দেখেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় আড়াই ঘণ্টার তল্লাসি অভিযানে বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নেয়া বিএনপি নেতাদের বের করতে দরজা ভেঙেছিল পুলিশ।

সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল খালেদা জিয়া কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন। সেদিন মহানগর নাট্যমঞ্চে দলের নির্বাহী কমিটির সভা ছিল।

সভার মধ্যাহ্ন বিরতির সময়ে তিনি এই কার্যালয়ে এসে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার সভায় ফিরে যান। কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় চেয়ারপারসনের দপ্তর।