প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অশনি সঙ্কেত: ফখরুল

প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পরিস্থিতিকে ‘আরও নৈরাজ্যকর’ করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2017, 04:04 PM
Updated : 22 August 2017, 05:23 PM

ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরদিন মঙ্গলবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এই আশঙ্কার কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “গতকাল (সোমবার) একটি দলীয় সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট, বিচার বিভাগ, বিচারকবৃন্দ এমনকি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা বিচলিত ও হতবাক হয়েছি।

“বর্তমান ক্ষমতাসীনরা রায়ের কারণে বিচার বিভাগকে আক্রমণের টার্গেটে পরিণত করে যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, তা দেশ, জাতি ও রাজনীতির জন্য এক অশনি সঙ্কেত বলেই আমরা মনে করি।”

এই পরিস্থিতিতে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা জনগণকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।”

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনতে সংবিধানে আনা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে তার প্রতিবাদ করে আসছে ক্ষমতাসীনরা।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সিনহা বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।

পর্যবেক্ষণে ‘বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে রায়ে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের নেতারা কড়া সমালোচনা করছেন, বাক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সিনহাও।

এসব প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক শুনানিতে পাকিস্তানে আদালতের রায় মেনে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের ঘটনা তুলে ধরেন। তাতে তিনি কার্যত শেখ হাসিনাকে ‘চোখ রাঙিয়েছেন’ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

শেখ হাসিনা এই অনুষ্ঠানেই প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন

শেখ হাসিনাও সোমবার এক অনুষ্ঠানে রায়ের সমালোচনা করে বলেন, “স্বাধীনতা ভালো, কিন্তু তা বালকের জন্য নয় বলে একটা কথা আছে। কাজেই ওই বালক সুলভ আচরণ আমরা আশা করি না।”

তিনি আরও বলেন, “সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে… এটা আমরা কিছুতেই সহ্য করব না।”

ফখরুল বলেন, “ক্ষমতাসীনদের অপছন্দের রায় দেওয়ার কারণে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তার বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতিকে সরে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন এবং বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেশের পরিস্থিতিকে আরও নৈরাজ্যকর করে তুলতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।”

“আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, ক্ষমতায় থেকে বিচার বিভাগ ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে এভাবে হেয় করলে তার পরিণাম কখনো শুভ হয় না। আমরা এই আত্মঘাতী পথ থেকে সরে আসার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন তিনি।

এই রায়কে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবারই এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, সামনে ‘তুফান’ আসছে।

অন্যদিকে দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বাংলাদেশে আবার ‘বিপদ’ আসবে বলে সতর্ক করেছেন দুই বাম দল সিপিবি ও বাসদের নেতারা।

জিয়াউর রহমান আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আসছে বিএনপি। রায় বদলাতে ক্ষমতাসীনরা আদালতের উপর চাপ দিচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।

রায় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে ফখরুল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়শ আমাদেরকে আদালতের রায় মেনে চলার পরামর্শ দেন।

“এবার তারা প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। বিচার বিভাগের ব্যাপারে তাদের নীতিই হচ্ছে, বিচার মানি কিন্তু তাল গাছ আমার।”

বনানীতে দলীয় চেয়াপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে  দলের স্থায়ী কমিটির  সদস্য মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা আতাউর রহমান ঢালী, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে নিয়ে হাজির হন ফখরুল।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতারা

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল বলে মনে করেন কি না- প্রশ্ন করা হলে বিএনপি  মহাসচিব বলেন, “অবশ্যই, নিঃসন্দেহে।”

প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের আল্টিমেটামের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “যেহেতু তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেনি, জবরদখল করে ক্ষমতায় বসে আছে। তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

“এজন্য বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এসব প্রতিষ্ঠানকে ধবংস করে দিয়ে তারা একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চায়।”

সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সম্পর্কের বিষয়ে ফখরুল বলেন, “রাষ্ট্রের তিনটি প্রতিষ্ঠান যদি একটা আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থায় থাকে তাহলে কোনোভাবে শুভ লক্ষণ নয়।”

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ বলেন, “একজন প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগ সম্পর্কে ও প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। এটা কোথাও দুনিয়ার কোনো দেশে সম্ভবপর নয়।

“আমার মনে হয়, উনি (শেখ হাসিনা) যদি সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত হতেন, তাহলে এরকম মন্তব্য তিনি করতেন না। উনি নির্বাচিত নন বলেই তার পক্ষে এসব কথা বলা সম্ভবপর হয়েছে।”

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের ঘটনার উদাহরণ টেনে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন, তা কীভাবে দেখছেন- প্রশ্ন করা হলে মওদুদ বলেন, “পাকিস্তানের প্রতি কারও ভালোবাসা থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রায় মেনে নিয়েছেন। এই যে স্পিরিটটা, এই স্পিরিটের কথা আমাদের প্রধান বিচারপতি বলেছেন। এটার সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে ভালোবাসা থাকার তুলনা করার অবকাশ নেই। এটা একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে ম্যালাইন করার জন্য।”

এসব প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট ‘সংযমের পরিচয় দিয়ে আসছেন’ উল্লেখ করে তার প্রশংসাও করেন পেশায় আইনজীবী মওদুদ।