সরকার দেশে সহিংসতা তৈরির চেষ্টায়: ফখরুল

সরকার ‘ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে সহিংস অবস্থা সৃষ্টি করতে চাইছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2017, 12:04 PM
Updated : 18 August 2017, 06:15 PM

শুক্রবার সকালে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারের অবস্থান ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য তুলে ধরে এ অভিযোগ করেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, “বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি ছিলেন, এদেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন তিনি। তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়ের পূর্বে পঞ্চম সংশোধনীর রায় দিলেন, সেই রায়ের বদৌলতে আজকে এই দেশ অস্থিতিশীল, এত অনিশ্চয়তা এত সহিংসতার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

“আমার কাছে যেন একটা জিনিস মনে হচ্ছে, সরকার এখন ইচ্ছা করেই একটা সহিংস অবস্থা তৈরি করতে চাইছে। সরকার এখন নিজেকে টিকিয়ে রাখবার জন্য এদেশের একটা অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্ট করতে চাইছে।”

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বতে অস্বীকার করা চেষ্টা দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা।

অন্যদিকে জিয়াউর রহমান আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলছে বিএনপি।

গত ১ অগাস্ট রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের পর ৯ অগাস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে এসে রায়ের পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচাপতি খায়রুল হক।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলন করার বৈধ্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল।

“তিনি (খায়রুল হক) প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি থাকার পরে পোস্ট অব প্রফিট, যেটা সেটা নেওয়া যায় না। কিন্তু নিয়েছেন, তিনি আবার প্রেস কনফারেন্স করছেন।”

খায়রুল হকের ওই সংবাদ সম্মেলনে করা নিয়ে সপ্তাহজুড়ে বিএনপির সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার ফের কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সংবিধানের পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতিরা সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে ‘অজ্ঞ-অশিক্ষিত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন বলে গণমাধ্যমে তুলে ধরা খায়রুল হক জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, “আজকের পত্রিকায় এসেছে যে, এই ষোড়শ সংশোধনীর মূল রূপকার তিনি (এবিএম খায়রুল হক)। সরকার যে এটা পাস করিয়েছেন তার মূল রূপকার তিনি। তাহলে আজকে জনগণের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এই বিচারপতি। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

“আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, অবিলম্বে তার পদত্যাগ করা উচিৎ। আইন কমিশনের পদ থেকে এবং তার বিচার হওয়া উচিৎ সংবিধান লঙ্ঘন করার জন্য।”

‘রাষ্ট্রের ভিত্তি ধ্বংসের চক্রান্তে আ. লীগ’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের ভিত্তি ধ্বংসের চক্রান্তের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল।

“তারা গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। এখন তারা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানে হাত দিয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে তিনটি মূল স্তম্ভ- পার্লামেন্ট, এক্সকিউটিভ ও জুডিশিয়ারি; দুইটো খেয়েছে, এখন তারা জুডিশিয়ারির ওপর হাত দিয়েছে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ধবংস করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রকাশ্যে সরাসরি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার একটা চক্রান্ত করছে।”

রায় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসায় গিয়ে রায়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এছাড়া বুধবার সন্ধ্যায় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তার সঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ছিলেন। সেখানে রায়ের বিষয়েও আলোচনা হয় গণমাধ্যমে এসেছে।

এসব ঘটনায় ‘রায়ের ওপর জোর করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা’ দেখছেন বিএনপি মহাসচিব।

মির্জা ফখরুল বলেন, “না হলে এই রায়ের পরে সরকারি দল ও সরকারের মন্ত্রী কী করে প্রধান বিচারপতির বাসায় যান? তারপরেই আমরা দেখলাম দেখলাম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল গেলেন। প্রকাশ্যে তারা (সরকার) বিচার বিভাগকে করায়াত্ব করতে শুরু করেছে। এই কারণে গোটা জাতি আজ উদ্বিগ্ন।

“আমরা আমাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বা লেখাপড়া শেখে যতটুকু দেখেছি, কখনো এই ঘটনা দেখিনি যে একটি অসামরিক ব্যবস্থাপনায় বিচার বিভাগের ওপরে এই ধরনের হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। কোথায় বাস করছি, কোন দেশে বাস করছি আমরা?”

সেগুন বাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি’র উদ্যোগে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক তথ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওই আলোচনা সভা হয়।

‘এরশাদ অতি চালাক’

আলোচনায় সাবেক স্বৈরশাসক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ‘অতি চালাক’ বলে আখ্যায়িত করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “দেশের সংসদে বিরোধী দল নেই। গৃহপালিত একটা বিরোধী দল আছে, উনার একেক সময়ে একেক রকম কথা। উনি (এরশাদ) কিছুদিন আগে বললেন বিএনপি নাকি বিষবৃক্ষ, যেটা নাকি আওয়ামী লীগ টিকিয়ে রেখেছে।

“উনি খুব সৌভাগ্যবান মানুষ, অতি চালাক। তিনি জানেন হাউ টু সারভাইব ইন পলিটিক্স। আমি বলব, আপনি নিজের কথা ভাবুন। আপনি কী করেছেন, এদেশের রাজনীতিকে কোন জায়গায় নিয়ে গেছেন… তারপরে অন্যের কথা ভাবুন।”

ফখরুল বলেন, “বিএনপিকে এত সহজেই পরাজিত করা যাবে না, এত সহজে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। বিএনপি গণমানুষের দল, এদেশের মানুষের দল, এই দল সংগঠন নির্ভর দল নয়। ইট ইজ প্লাটফর্ম অব দি পেট্রিয়টি এলিমেন্টস অব দিস কান্ট্রি।”

আলোচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার সমালোচনাও করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “আজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতক্যৈ সৃষ্টি করবার দায়িত্ব তার নয়। আমরা বলতে চাই, আইনে কি আছে না আছে বড় কথা নয়; বাস্তবতা আপনাকে দেখতে হবে। আপনি কাদের নিয়ে নির্বাচন করবে? এই রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করবেন।

“তারা যদি মনে করে যে, নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই তাহলে আপনি কোন নির্বাচন করবেন? ওই রকিবমার্কা নির্বাচন করবেন ২০১৪ সালের মতো, সেটা হবে না, সেটা এদেশের মানুষ এবার করতে দেবে না। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি মতো তামাশা নির্বাচন আমরা করতে দেব না, জনগণ দেবে না।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “এখানে আলোচনা করতে হবে, কথা বলতে হবে। সরকারকেই তার উদ্যোগ নিতে হবে, যদি তারা দেশের ভালো চান। নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে। আপনার দায়িত্ব কী আছে না আছে সেটা দেশের মানুষই জানে। আপনি উদ্যোগ নিন, সেটা কতদূর কী হয়। সংলাপ ছাড়া সমঝোতা ছাড়া দেশে কোনোদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।”

এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসার পরিচালনায় আলোচনায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব সাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের সভাপতি সৈয়দ এহসানুল হুদা, স্বাধীনতা ফোরামের সভাপতি আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ এবং জাতীয়তাবাদী নাগরিক ফোরামের সভাপতি মিয়া মো. আনোয়ারসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।