নিজের স্কুলে আবেগতাড়িত অ্যাটর্নি জেনারেল, রাজনীতিতে নামার ইঙ্গিত

ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে টিনের চালা আর বাঁশের বেড়ার ঘরের যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল, সেই স্কুলের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়ে আবেগ আর ধরে রাখতে পারলেন না রাষ্ট্রের এই প্রধান আইন কর্মকর্তা।

সুলাইমান নিলয় মুন্সীগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2017, 07:35 PM
Updated : 12 August 2017, 07:35 PM

শনিবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কাজির পাগলা এ টি ইনস্টিটিউশনে বই বিতরণ করতে এসে যেন নিজের ছোটবেলায় ফিরে গেলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

অনুষ্ঠানে মাদকবিরোধী লড়াইয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজ এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।

১৯৫৩ সালে এই বিদ্যালয়ে নিজের শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মাহবুবে আলম।

পরে ঢাকায় গিয়ে পগোজ স্কুল, আরমানিটোলা সরকারি স্কুল, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরপরও এই স্কুলের স্মৃতি ভোলার না।

“এই স্কুলে যখন পড়তাম, এই মাঝখানে ছিল একটা টিনের ঘর। এটাকে আমরা বলতাম লাইব্রেরি। শিক্ষকরা এখানে বসতেন। প্রধান শিক্ষকও বসতেন।

“চারদিকেও টিনের ঘর।সেখানে কতগুলো ঘরে টিনের বেড়া ছিল না, বাঁশের বেড়া ছিল। সেই স্কুলেই আমার শিক্ষা জীবন শুরু।”

বর্তমানে এই বিদ্যালয়টিতে ছাত্রীদের ভর্তির হার বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন মাহবুবে আলম।

“আজ আমি দেখছি, আমার বাম দিকে ছাত্রদের চেয়ে ডান দিকে ছাত্রীরা সংখ্যায় বেশি। তখন একজন ছাত্রীও স্কুলে ছিল না। আমরা কেবল ছেলেরাই স্কুলে পড়তাম।”

ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “তখন আমরা খালি পায়ে স্কুলে আসতাম। উপরের ক্লাসের ছেলেরা অনেকে লুঙ্গি পরে ক্লাসে আসত। কেডসের কথা কল্পনাই করা যেত না। এখন ছেলে-মেয়েরা কেডস পরে আসছে, ভালো পোশাক পরে আসছে।

“আজ চারদিকে দালান, স্কুলগেট এগুলোর কিছুই ছিল না। আমরা দেখতাম- বাজারের কুকুরও স্কুলে ঢুকে যেত।”

প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানের কারণে শহরের বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে শিক্ষার্থী হীনমন্যতায় না ভোগার পরামর্শ দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি বলেন, “এই স্কুল থেকেই পড়াশোনা শুরু করে আজ আমি দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদক ছিলাম।কথাগুলো বললাম যাতে তোমাদের মাঝে যেন কোনো হীনমন্যতা না থাকে। কলমা স্কুল (পাশের গ্রামের) থেকে পড়ে ইউসুফ সাহেব প্রখ্যাত চিকিৎসক হয়েছেন।

“এখান থেকে ঠিকমতো পড়াশোনা করলে তোমরাও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। এজন্য দরকার একাগ্রতা। পড়াশোনার প্রতি একান্ত প্রচেষ্টা।”

এদিনের অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত বই বিতরণের। সম্প্রতি নিজ এলাকার বিদ্যালয়ে বই নিয়ে যাচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তারই ধারাবাহিকতায় গিয়েছিলেন নিজের প্রথম স্কুলেও।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলপত্র, ৩০ খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাবলী সমগ্র নিয়ে যান তিনি।

সব শ্রেণিতে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের দেন বঙ্গবন্ধুর জীবনী গ্রন্থ। শিক্ষকরাও এই বইয়ের একটি করে কপি পান। দেওয়া হয় স্কুলের লাইব্রেরিতেও। মুক্তিযুদ্ধের আরওে নানা বইসহ বাকীগুলো দেওয়া হয় স্কুলের লাইব্রেরিতে।

শোকের মাসে এই আয়োজনে তিনি ফিরে যান অগাস্টের দিনগুলোতে।

মাহবুবে আলম বলেন, “শোকের এই মাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আমাদের মনে পড়ে। কী নিদারুণ হত্যা! এই হত্যা কারবালার ইতিহাসের মতো।

“আজকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের উপর যদি বিষাদ সিন্ধুর মতো বই লেখা হত, তাহলে সেই বই পড়ে মা-বোন সবাই কাঁদত। বিষাদ সিন্ধুর মতো বই লেখা হয়নি। হয়ত ভবিষ্যতে লেখা হবে।”

এই রকম বইয়ের অভাব পূরণে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ার আহ্বান জানান তিনি।

মাহবুবে আলম বলেন, “বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী যদি তোমরা পড়, তাহলে তোমরা বুঝতে পারবে, এই দেশের জন্য এই জাতিকে সংগঠিত করতে, একটি দেশকে স্বাধীন করতে উনার কী স্বপ্ন ছিল। কীভাবে উনি এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত আত্মজীবনী সকল শিক্ষার্থীর পড়া একান্ত কর্তব্য।”

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বইয়ে বলা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগের কাহিনী। কীভাবে এই যুদ্ধ হলো সেই কাহিনী।”

ব্যক্তি জীবনে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত মাহবুবে আলম বলেন, “রবীন্দ্রনাথ আমাদের একটি বিরাট চেতনা। তার গান জাতীয় সংগীত, এটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই আমরা গাই। ‘আমার সোনার বাংলা’-এই গান আমাদের প্রেরণা দিয়েছে। ৩০ খণ্ডে তার সব রচনাবলীও পাওয়া যাবে স্কুলের লাইব্রেরিতে।

আনিসুল হকের লেখা ‘মা’ উপন্যাসসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্য বইগুলো পড়তেও তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এই স্কুলের বয়স ১১৬ বছর। এই স্কুল থেকে আমাদের অনেক জ্ঞানীগুনী ছাত্র বেরিয়ে গেছেন। কেউ বিচারপতি হয়েছেন, কেউ সচিব, কেউ অন্যান্য জায়গায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।

“এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখনও স্কুলকে স্মরণ করেন। এই স্কুলের শতবর্ষ যখন পালিত হয়, সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা দিপালী নাগ এই স্কুলে এসেছিলেন। এই মাঠে গান গেয়েছিলেন। তোমাদের গর্ব করা উচিত-এমনই এক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী তোমরা।”

শত স্মরণিকার একটা বইকে উদ্বৃত করে তিনি বলেন, এক ছেলে প্রথম বিভাগে মেট্রিকে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু ফল নিতে এসে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে স্কুলেই সে মারা যায়।

“এই এলাকায় এক সময় কলেরা-বসন্ত নানা রোগ ব্যাধি ছিল। আজকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য সেগুলো আর হচ্ছে না।

রাজনীতিতে নামার ইঙ্গিত

অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে নামার ইঙ্গিত দেন মাহবুবে আলম।

তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে আমি সিরাজুল আলম খানের আমন্ত্রণে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে গিয়েছিলাম। ওই দিন মসজিদে অনেকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তখন আমি বলেছিলাম, আমি সামনে নির্বাচন করতে চাই।

“সেই থেকে সবাই জানে যে, আমি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আজ যেহেতু শিক্ষার্থীদের সামনে আছি, সেই জন্য নির্বাচনের কথা বলব না।

“তবে আমি অনুভব করি, দুইটা বিষয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। ইয়াবা এবং মদ ও জুয়া। এগুলো থেকে আমাদের মুক্ত করতে হবে। ছেলে-মেয়েরা ক্লাস টেনে পড়ে। এদের হাতে যদি ইয়াবা পৌঁছে যায় তাহলে এই সভ্য দেশ আর থাকবে? কাজেই ইয়াবা-মদ-জুয়া থেকে এলাকাকে মুক্ত রাখতে হবে।

“আরেকটা জিনিস, সরকারের পক্ষ থেকে যদি সম্ভব নাও হয়, স্কুলগুলোতে দুপুরে ছাত্র-ছাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা। পশ্চিমবঙ্গে অনেক আগে থেকে বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়।

“বাংলাদেশ সরকার থেকেও প্রত্যেকটা ইউনিয়নে একটা করে স্কুলে ব্যবস্থা করা আছে। আমার মতে, সব প্রাইমারি স্কুলে, সম্ভব হলে হাই স্কুলেও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এককভাবে সম্ভব না হলে বিত্তবানদের সম্পৃক্ত করে করতে হবে।

“একবার শুরু হলে দুটো লাভ হবে, ছেলে-মেয়েদের উপস্থিতি বেড়ে যাবে। সারাদিন না খেয়ে স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। আমি মনে করি, এই ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি হোক।

“আমি জানি দেশের অনেক বিত্তবান লোক এলাকায় আসতে চান, স্কুল-কলেজগুলোতে অনেক কিছু করতে চান। কিন্তু তারা কোনো পথ পাচ্ছেন না। এমন জিনিস শুরু হয়ে গেছে, যে একবার লঙ্কায় যায়, সেই রাবণ হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “রাজনীতি করতে হলে ত্যাগী হতে হবে। রাজনীতির অর্থ এই না যে, আসলাম খালি হাতে, যাব ভরা হাতে। রাজনীতির অর্থ হচ্ছে, যেভাবে এসেছি, সেভাবেই যাব। সম্ভব হলে ভরা হাতে এসে খালি হাতে যাব। নির্বাচন বা রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। সবার এই চেতনা ধারণ করা উচিত।

“রাজনীতি অর্থ হচ্ছে, দেশ সেবা। জনগণ যাতে এই কথা বলতে না পারে, তিনি জনগণের অর্থে এই করেছেন, ওই করেছেন। এটিই হবে আমাদের সবার চিন্তা-চেতনা।”

স্কুলের ৩০০ শিক্ষার্থীকে স্কুল ড্রেস এবং নিয়মিতভাবে ৫০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল নামে অন্য এক শিক্ষার্থীও বক্তব্য রাখেন।