ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে মন্ত্রিসভার প্রতিক্রিয়া উদ্বেগজনক: ফখরুল

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে মন্ত্রিসভার প্রতিক্রিয়া ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2017, 04:37 PM
Updated : 8 August 2017, 04:55 PM

মঙ্গলবার বিকালে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “গতকাল (সোমবার) মন্ত্রিসভায় কয়েকটা কমেন্ট করা হয়েছে এই রায় (ষোড়শ সংশোধনী বাতিল) সম্পর্কে, যেটা সত্যিই উদ্বেগজনক। যেখানে আমাদের সকলের আশা-ভরসার শেষ স্থল বিচার বিভাগ, আপিল বিভাগ, সেখান থেকে যখন একটা রায় আসে, কিছু অবজারভেশন আসে, তখন সমগ্র জাতি মেনে নেয়। শুধু মেনে নেয় নয়, তারা সেটাকে মানতে চেষ্টা করে।

“সেখানে তারা(ক্ষমতাসীনরা) বলছেন যে, জনমত তৈরি করবেন। কার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করবেন? এই ১৬ কোটি মানুষের মনের চিন্তা-ভাবনা যে রায়ের মধ্য দিয়ে এসেছে, যে অবজারভেশনের মধ্য দিয়ে এসেছে তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করবেন? জনগণ আপনাদের সাথে থাকবে না। জনগণ আপনাদের সাথে নেই বলেই আপনারা এই সমস্ত কথা বলছেন।”

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের এই আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ অভিহিত করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম।

সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ অগাস্ট প্রকাশ হয়।

সোমবার প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় এই রায় নিয়ে মন্ত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে সংবাদমাধ্যমের খবর।

এর আগে গত শুক্রবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে ওই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “এটা আমরা অ্যাসেম্বলিতে আবার পাস করব.. এই আইনটা। এই কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টটা আমরা আবার পাস করব এবং অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিসিয়ারি কতদূর যায়।”

ওই বক্তব্যের জন্য অর্থমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন।

আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রী ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে আদালত অবমাননা করেছেন। আমরা বলতে চাই, তিনদিনের মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে মাফ চাইতে হবে। নইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হযেছে।”

ফোরামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “অর্থমন্ত্রী রাবিশ মন্ত্রী, গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সুয়োমোটোর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হোকে। তিনি ‍জুডিশিয়ারিকে অপমান করেছেন।”

রায় নিয়ে মন্ত্রিসভার প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, “আমি মর্মাহত হয়েছি আজকে সব কাগজে দেখলাম যে, আমাদের ষোড়শ সংশোধনীর উপরে সুপ্রিম কোর্ট যে ঐতিহাসিক যুগান্তকারী একটি রায় দিয়েছেন, এই রায়ের ওপরে মন্ত্রিসভা আলোচনা করেছেন, সেখানে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমি আতঙ্কিত বোধ করছি, কারণ তারা বলেছেন যে তারা জনমত সৃষ্টি করবেন।

“বাংলাদেশে তারা জনমত সৃষ্টি করবেন এই রায়ের বিরুদ্ধে। মানেটা কী? এর মানেটা হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা জনমত সৃষ্টি করতে চান। তারা তো তাহলে নিজেরাই প্রমাণ করে দিচ্ছেন তারা দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগে বিশ্বাস করে না। আমি বলতে চাই যারা এই যুগান্তকারী রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন না, দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ চান না।”

আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকের চাকরির মেয়াদ শেষে তাকে দুই বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ।

তিনি বলেন, “আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দুই বছর সরকার এক্সটেনশন দিয়েছে উইদাউট কনসালটেশন অব চিফ জাস্টিস। আজকে এজে মোহাম্মদ আলী সাহেব রিট ফাইল করে এসেছেন। তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর থাকল কোথায়? তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে  না।”

বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা তাকে অত্যন্ত সজ্জন মানুষ হিসেবে জানি। আর ইদানিং খুব সন্দুর সুন্দর কথা বলছেন। তার কথায় আমরা সবাই বেশ আমোদ পাই।

“উনি (ওবায়দুল কাদের) গতকাল বলেছেন, বিএনপি নাকি আদালত আর বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যেতে চায়। আমি বলতে চাই, কার কথা কে বলে?”

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “এই খায়রুল হকের (সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) রায়ের উপরে আপনারা ক্ষমতায় টিকে আছেন। এদেশের সব মানুষ জানে কোন বিদেশিদের কর্মতৎপরতায় আপনারা ক্ষমতায় টিকে আছেন। সুতরাং বিএনপিকে একথা বলবেন না।”

দেশে এখন ‘দুঃসময়’ চলছে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে কথা নেই, বার্তা নেই মানুষকে তুলে নিয়ে যায়, গুম করে দেয়। ফরহাদ মজহারের মতো মানুষকে তুলে নিয়ে যায়, ইলিয়াস আলীর মতো নেতার খোঁজ আমরা পাই না। হাজার হাজার তরুণকে তারা হত্যা করেছে, শতাধিক মানুষকে তারা গুম করেছে, জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। অস্বীকার করে আবার আমরা তুলে নিয়ে যাইনি।

“এখন পর্যন্ত সারা দেশে আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৪ হাজার। ১০ লাখের ওপরে আমাদের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। আমরা জরিপ করাচ্ছি। আমাদের লোকজন বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে সেসব তথ্য তুলে নিয়ে আসছেন। প্রতিদিন নতুন নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, আমাদের দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করতে না দেওয়া।”

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান ফখরুল।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদলের পরিচালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আমীনুল হক, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী বক্তব্য রাখেন।

সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মীর নাসির,  চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ জে মোহাম্মদ আলীসহ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।