আওয়ামী লীগের কথা শুনে ‘হাসি পায়’ ফখরুলের

বাহাত্তরের সংবিধানে পঁচাত্তরে সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যে সংসদের কাছ থেকে যে বঙ্গবন্ধুর আমলেই সরানো হয়েছিল, তা আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2017, 12:19 PM
Updated : 10 July 2017, 01:09 PM

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে বিএনপিবিহীন সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় ফখরুল চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এখন আওয়ামী লীগের মুখে গণতন্ত্রের কথা শুনে তার হাসি পায়।

বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে সংবিধানে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল, তা সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।

ওই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রোববার সংসদে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ, জাসদ ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।

তার প্রতিক্রিয়ায় সোমবার ঢাকার নয়া পল্টনে মওলানা ভাসানী মিলনায়তনে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ‘সদস্য সংগ্রহ অভিযান’ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের প্রসঙ্গ তোলেন ফখরুল।

বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। চতুর্থ সংশোধনের ফলে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। এরপর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল, যা ষোড়শ সংশোধনে বাদ দেওয়া হয়।

ফখরুল বলেন, “চতুর্থ সংশোধনীতে এই বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা আপনারাই তো রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়ে দিয়েছিলেন। ভুলে গেছেন? এখন সেটা মনে পড়ে না।

“ভুলে গেছেন যে, আপনারাই সমস্ত কথা বলার অধিকার হরণ করে দিয়েছিলেন, পত্রিকায় লেখা ও পত্রিকা প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, অন্য কোনো সংগঠন করা যাবে না- এসব ভুলে গেছেন?”

গণতন্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, “বড় বড় কথা বলে প্রত্যেকদিন। গণতন্ত্রের একমাত্র ধারক-বাহক হয়ে বসে আছে। কালকে (রোববার) সংসদে বহু লেকচার করেছেন, তুলোধুনো করেছে বিচার বিভাগকে।

“১৯৭২ সালে যে সংবিধান তৈরি করা হল, সেই সংবিধানকে এক এক করে শেষ করলো কে? এই আওয়ামী লীগ। তারা বিশেষ ক্ষমতা আইন করল, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করল। এরপর যখন তাও সামাল দিতে ব্যর্থ, তখন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল করেছে।”

“সেই তারা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে, তখন আমরা যারা বয়ঃবৃদ্ধ মানুষ আছি, যারা দেখিছি, আমরা না হেসে তো পারি না,” বলেন ফখরুল।

বিচার বিভাগকে চাপে রাখতেই আওয়ামী লীগ সং বিধানের ষোড়শ সংশোধন করেছিল বলে দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। এই প্রসঙ্গে নিজের বিরুদ্ধে একটি মামলার প্রসঙ্গও টানেন তিনি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ফাইল ছবি)

“আমার বিরুদ্ধে একটা মানহানির মামলা করেছে। মানহানি করলাম প্রধানমন্ত্রীর, মামলা করল তাঁতী লীগ না স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন। মামলা এমনিতেই হবে না, অথচ বিচার কাজ শুরু করেছে। এই যে আইনকে তারা তাদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়।

“আরে সেজন্যই তো আমাদের বিচারক মহোদয়রা বলেছেন যে তোমরা আবার বিচারকদের অভিশংসন করবা কী? তোমরা তো তোমাদেরটা ছাড়া কিছু দেখবা না। সুতরাং তোমাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সেজন্য তারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছেন।”

“লজ্জা নাই? যেহেতু পার্লামেন্টে ইমিউনিটি আছে, যা খুশি তা বলতে পারে, বলতেছে। আমাদেরও বাইরে ইমিউনিটি আছে, আমরাও আপনাদের সমালোচনা করতে পারি,” সরকারের উদ্দেশে বলেন তিনি।

বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের মামলাকে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সঙ্গে তুলনা করে ফখরুল।

“নর্থ কোরিয়া যেমন মিসাইল মারে মাঝে মাঝে। এদের (সরকার) অস্ত্র হচ্ছে কী মিথ্যা মামলা। মামলা করো, আদালতে ওদের সময় কাটবে।

“উত্তরের সভাপতি এম এ কাইয়ুম সাহেবের (বিদেশে আত্মগোপন) বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিল। ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা মারা গেল গুলশানে। একদিনও যায়নি প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্ক থেকে বললেন, এই হত্যার সাথে না কি বিএনপি জড়িত। এরপর তারা যা করার, তাই তো করতেছে।”

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুন্সি বজলুল বাসিত আনজুর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সম্পাদক এ জি এম শামসুল হকের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানও বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে নাসির উদ্দিন, সবুজ মিয়া, আমান উল্লাহ ভুঁইয়া, মো. বাসেত, সোহেল রানা, মেহেরুন্নেসা দলের মহাসচিবের হাত থেকে নতুন সদস্য ফরম সংগ্রহ করেন।

‘যদি তা হত, তবে কি আমরা চাইতাম’

শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার চাইত না বলে দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল।

তিনি বলেন, “প্রতিদিন সরকারি দল বড় বড় কথা বলছে। প্রতিদিন বলছে, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন হবে। আরে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হইত, তাহলে কী আমরা চাইতাম? হবে না বলেই তো আমরা চাচ্ছি।”

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কথাও বলেন বিএনপি মহাসচিব।

ভোটে সবার জন্য সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনি থাকবেন ক্ষমতায়, আপনি হেলিকপ্টার চড়ে নৌকায় ভোট চাইবেন; আর আমাদেরকে পাঠাবেন আদালতের বারান্দায়, জামিন দেবেন না, ওখান থেকে চলে যেতে হবে কেন্দ্রীয় কারাগারে অথবা কাশিমপুরে।

“তাই বলছি, দেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, আমাদেরকেও ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা গণতন্ত্রের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছি, আমাদের নেত্রী করেছেন, আমরা করতেই খাকব যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হবে।”

দলের নেতা-কর্মীদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান বিএনপি মহাসচিব।

“সমস্ত জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে। মানুষ অপেক্ষা করে আছে। আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে দিয়ে এখন একটাই কাজ এই সরকারকে সরানো, এখন একটাই কাজ নির্বাচনে ধানের শীষকে জয়লাভ করানো।”

সরকারের ‘দুঃশাসন ও ব্যর্থতার’ কারণে অর্থনীতি আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেন ফখরুল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অঞ্চলে ভূমিধস ও উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়েও সরকারের সমালোচনা করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “মানুষের কথা ভাববার সময় কোথায় ওদের। খেয়াল করে দেখবেন, ওদের চেহারা বদলে গেছে, প্রত্যেকের চেহারা বদলে গেছে। আবার গাড়ির মডেল বদলে গেছে। বাড়ি-টারি চেইঞ্জ নতুন করে হচ্ছে, বিদেশেও হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা তাদের চিন্তার সময় নেই।”