রাঙামাটিমুখী ফখরুলদের গাড়িবহরে রাঙ্গুনিয়ায় হামলা

পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত রাঙামাটিতে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় হামলার মুখে পড়েছে বিএনপির গাড়িবহর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2017, 06:45 AM
Updated : 18 June 2017, 05:31 PM

এতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন। ফখরুল বলছেন, এই হামলা ‘গণতন্ত্রের উপর আঘাত’।

রোববার সকালে এই ঘটনার পর রাঙামাটি না গিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে হামলার জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদকে দায়ী করেছেন বিএনপি নেতারা।

হাছান মাহমুদ হামলায় আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকারের পাশাপাশি বিএনপি নেতাদের ফিরে আসা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করায় ক্ষোভ জানিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এর পরিণতি শুভ হবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের গাড়িতে হামলা ‘ঠিক হয়নি’ মন্তব্য করে বলেছেন, হামলাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ প্রধানকে বলেছেন তিনি।

সম্প্রতি রাঙামাটিসহ চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচটি জেলায় পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শুধু রাঙামাটিতে নিহত হয় ১১৫ জন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে পাহাড় ধসে সর্বাধিক প্রাণহানির এই ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলে আসা বিএনপি পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে রোববার প্রতিনিধি দল নিয়ে রওনা হয়।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল আলম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমও ছিলেন।

তারা সকালে চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে রওনা হন। সেখান থেকে নৌপথে তাদের রাঙামাটি যাওয়ার কথা ছিল।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছাখালী এলাকায় হামলার মুখে পড়ে ফখরুলদের এই গাড়িবহর।

হামলায় ভেঙে যায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ির সামনের কাচ

ঘটনার পরপরই আমীর খসরু টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একদল লোক রড ও দা নিয়ে আমাদের গাড়ি বহরে হামলা চালায়। তারা বৃষ্টির মতো পাথর মারছিল। আমাদের গাড়ি চুরমার করে ফেলেছে।”

গাড়ির কাচ ভেঙে শরীরে লেগে ফখরুল ও আমীর খসরু আহত হন। আহত হন রুহুল আলম চৌধুরী, মাহবুবুবর রহমান শামীম ও ছাত্রদল নেতা গোলাম নবীও।

আমীর খসরু তখনই বলেন, “আওয়ামী লীগের হাছান মাহমুদের লোকজন এই হামলা চালিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”

হামলার পর রাঙামাটি যেতে না পেরে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চট্টগ্রাম ফিরে এসে দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন।

হামলার পর চট্টগ্রামে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, “এ আঘাত গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত। যারা মুক্ত চিন্তার কথা বলে, এ সরকারের খারাপ কাজগুলোর বিরোধিতা করে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার- তাদের প্রতি এ আঘাত। যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন- এ আঘাত তাদের প্রতি।

“আওয়ামী লীগের চরিত্র আবার উদঘাটিত হয়েছে। সবসময় মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে এলেও তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। ভিন্নমতেও তারা বিশ্বাস করে না। সহনশীলতা বলতে তাদের মধ্যে কিছু নেই।”

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

সংবাদ সম্মেলনে আমীর খসরু বলেন, “একদিকে দেশ ও জাতির সমস্ত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্গত মানুষের পাশেও আমরা দাঁড়াতে পারব না। আপনি এখন ত্রাণও দিতে পারবেন না।

“একটি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ সেক্রেটারি জেনারেলের ওপর এ আক্রমণ। এরপর আর বাকি থাকল কী? এরপর কি আর কোনো রাজনীতি থাকে? এরপর তারা কী চায়?”

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে হামলার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফখরুল বলেন, দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তারা রাঙামাটি যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন।

“বিমানবন্দর থেকে আমরা রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা হই। পথিমধ্যে জানতে পারি সড়কে যে অংশ ভাঙন আছে, সেখান দিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই কাপ্তাই গিয়ে সেখান থেকে নদী পথে রাঙামাটি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।”

“আমাদের গাড়িবহর রাঙ্গুনিয়া থানা অতিক্রম করে ইছাখালী বাজারে পৌঁছায়। সেখানে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। এ সময় ৩০-৪০ জন যুবক লাঠি, হকিস্টিক ও পাথর নিয়ে হামলা চালায়। গাড়ির সামনের কাঁচ একটি বড় পাথর দিয়ে ভেঙে ফেলে। তারপর হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করতে থাকে।”

আকস্মিক এই হামলার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিএনপি নেতারা। 

হামলার পর ফিরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

ফখরুল বলেন, “আমরা তো সেখানে কোনো জনসভা করতে যাইনি। আমাদের পার্টির মিটিংও করতে যাইনি। যারা নিহত হয়েছেন সেসব পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে যাচ্ছিলাম।”

এই হামলাকে ‘অবিশ্বাস্য’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থা যদি এই হয়, সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? আমি মনে করি, এ আক্রমণ গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ। সুস্থ চিন্তার মানুষের প্রতি আক্রমণ।”

রাঙ্গুনিয়ার এই হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব সোমবার সারাদেশে বিক্ষোভের কর্মসূচি দেন।

চট্টগ্রামের সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে’ পরাজিত করতে পারাটাই হবে এর প্রতিবাদ।

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ির পেছনের অংশ

পাহাড়ে দুর্যোগের ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ পুনর্বার তুলে তিনি বলেন, পাহাড়ে এত প্রাণহানির পর সরকারের উচিৎ ছিল রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা। কিন্তু জনগণের প্রতি তাদের কোনো মায়া-মমতা-দরদ নেই।

পাহাড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা পরে পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানান বিএনপি মহাসচিব। সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি ঢাকায় রওনা হন।

হাছান মাহমুদের অস্বীকার

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ওই বহরের গাড়ির ধাক্কায় স্থানীয় দুজন আহত হলে তারাই প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মির্জা ফখরুল রাঙামাটি যাওয়ার পথে ইছাখালী এলাকায় তাদের গাড়ির ধাক্কায় স্থানীয় দুজন আহত হয়। এতে বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”

আহত দুজন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন বলে তিনি জানান।  

এই ঘটনার পর বিকালে রাঙ্গুনিয়া পৌর এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করতে স্থানীয়দের নিয়ে নামেন স্থানীয় সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদম সেখানে তাকে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে কাজ করতে দেখা যায়।  

বিকালে রাঙ্গুনিয়ায় মাটির ঝুড়ি মাথায় হাছান মাহমুদ

হামলার ঘটনাটিকে ‘অনভিপ্রেত’ মন্তব্য করে হাছান মাহমুদ বলেন, তার লোকজন হামলা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ বিএনপি নেতারা করেছেন, তা সঠিক নয়।

“ওই এলাকার সব মানুষ আমার ভোটার। স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, এতে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত না।”

ঘটনার পর পুলিশি নিরাপত্তায় বিএনপি প্রতিনিধি দলকে রাঙামাটি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও তারা সেখানে যাননি বলে দাবি করেন হাছান মাহমুদ।

“কিন্তু তারা চট্টগ্রামে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন করছেন, এটা রহস্যজনক।”

বিএনপির গাড়িবহরের ধাক্কায় দুই পথচারী আহত হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে শামীম বলেন, “দিনে-দুপুরে তারা হামলা চালিয়েছে, এখন মিথ্যা বলছে। গাড়ির সাথে দুর্ঘটনার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”

“এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে এরকম ন্যক্কারজনক হামলা দেখিনি,” বলেন চাকসুর সাবেক এজিএস শামীম।

ওবায়দুল কাদের বললেন, হামলাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে

এদিকে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুপুরে ঢাকায় নিজের এক কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “বিষয়টি ঠিক হয়নি। যারাই করুক এটা অন্যায় হয়েছে।

“আমি আইজিপির সঙ্গে কথা বলেছি, নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করতে বলেছি।”

অন্যদিকে সন্ধ্যায় এক ইফতার অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, “আমি জানতে চাই, মহাসচিবের উপর এই হামলা হল, তারপর কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? অথচ আমাদের লোকজন কিছু না করলেও সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়।”

এই ঘটনাটিকে সারাদেশের মানুষের নিরাপত্তাহীনতার নজির হিসেবে দেখিয়ে তিনি বলেন, “ওদের ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে, জেলে পুরতে হবে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।”