সেই ভুল যেন বিএনপি আর না করে: প্রধানমন্ত্রী

‘ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞ ও দুর্নীতি ছেড়ে’ খালেদা জিয়াকে ‘সঠিক ও সুস্থ রাজনীতির’ পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রিয়াজুল বাশার স্টকহোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2017, 04:16 AM
Updated : 16 June 2017, 06:54 AM

সেইসঙ্গে ২০১৪ নির্বাচনে ‘না আসার ভুল’ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। 

বৃহস্পতিবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের সিটি কনফারেন্স সেন্টারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের এক সংবর্ধনা সভায় এ আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসীরা এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য দেশকে উন্নত করা আর বিএনপির উদ্দেশ্য দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া। খালেদা জিয়ার হৃদয়ে বাংলাদেশ নাই। তার হৃদয়ে পেয়ারে পাকিস্তান।

“বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন হলে উনার ভাল লাগে না। উনি খালি দেখেন ধ্বংসই হয়ে যাচ্ছে। আজকেও এ ধরনের কি এক বক্তৃতা দিয়েছেন। বাংলাদেশের নাকি খুব খারাপ অবস্থা।”

বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদার বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “দুর্নীতি করে এতিমের টাকা যারা চুরি করে খেয়েছে। আর মামলা মোকাবিলা করতে ভয় পায়। ১৪০ বার সময় নিয়ে ১৫০ বার উচ্চ আদালতে রিট করে হেরে যায়। দুঃসময়টা তাদের। বাংলাদেশের না।”

খালেদা জিয়ার সমালোচনার মধ্যে তার স্বামী জিয়াউর রহমান ও ছেলে তারেক রহমানের প্রসঙ্গও আসে প্রধানমন্ত্রীর কথায়। 

“সে যেমন ম্যাট্রিক ফেল, অবশ্য জিয়াউর রহমান ম্যাট্রিক পাস, আর তার ছেলে কদ্দুর পাস তা আর আমি বলতে চাই না। আপনারাই ভাল জানেন। কাজেই এই হল তাদের অবস্থা।

“তারা অর্থ-সম্পদ ওইগুলি শিখেছে, হাওয়া ভবন খুলে পাওয়া-নেওয়া বুঝেছে, কমিশন নেওয়া বুঝেছে, দুর্নীতি করা বুঝেছে। বাংলাদেশের জনগণ যখন ভাল থাকে তখন উনার ভাল মনে হয় না। লুটপাট করতে পারলেই তার ভাল লাগবে। মানুষ খুন করতে পারলেই তাদের ভাল লাগবে। দেশের সম্পদ ধ্বংস করতে পারলে তখন তার ভাল লাগে।”

বিএনপি চেয়ারপারসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি বলব, এইসব পথ ছেড়ে দিয়ে সঠিক, সুস্থ রাজনীতির পথে আসুক। ২০১৪ এর নির্বাচনে না গিয়ে যে ভুল করেছে ভবিষ্যতে যেন আর সেই ভুল না করে। বরং নির্বাচনে আসুক। গণতান্ত্রিক ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে, এই খুন খারাবির পথ যেন তারা পরিহার করে- সেটাই আমরা চাই।”

অর্থ পাচারের দায়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সাজাটা মাথায় নিয়েই কিন্তু বিদেশে আছে। আজকে যদি অপরাধী না হয়, তাহলে বিদেশে পড়ে থাকবে কেন?”

“খালেদা জিয়া নিজেও কম যান না। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, আরও একটা কেসে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই মামলায় ১৪০ বার কোর্টে সে সময় নেয়।… এদিকে মিটিং করে বেড়ায়, সাজুগুজু করে দাওয়াতও খান। ওদিকে অসুস্থতার কথা বলে কোর্টে যেতে পারেন না।… পলায়নপর মনোবৃত্তি।”

প্রবাসীদের এই সংবর্ধনায় এসে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসেরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে ইউনূসকে যখন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে ‘ফোন করিয়েছিলেন’ বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে তিনবার যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমার একটা প্রশ্ন ছিল, একজন নোবেল লরিয়েট হয়ে গেছেন তিনি (ইউনূস)। একটা এমডি পদের জন্য লালায়িত কেন? আসল মাজেজাটা এখন ধীরে ধীরে বের হচ্ছে। কত টাকা তিনি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন?

“বিদেশে তার ইনভেস্টমেন্ট করা, বিদেশে তার টাকা দেওয়া। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে টাকা দেওয়া… কোথা থেকে কীভাবে ওই টাকাগুলো তিনি দিলেন? এগুলো এখন প্রশ্ন এসেছে।”

দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করার পেছনেও যে ‘তাদের হাত আছে’- সে বিষয়ে ‘কোনো সন্দেহ নেই’ বলে জানান শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, “দেশের সেবা করতে এসেছি, তাদের মত গরীবের টাকা বা গরীবের রক্ত চুষে খেতে আমরা আসিনি।”

২০১৩ সালে যুদ্ধপরাধের বিচারের বিরোধিতায়, ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টায় এবং ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, পরিবহন ও অবকাঠামো ধ্বংস করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে’ বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “হত্যাকাণ্ড ছাড়া কিছুই বোঝে না, ধ্বংস করা ছাড়া যেন আর কোনো কাজ তারা জানে না। মানুষ সে কথা ভুলে গেছে, যে কীভাবে মানুষের অত্যাচার তারা করেছে?”

শেখ হাসিনা বলেন, “যারা মানুষ, যাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, যারা মানুষের জন্য রাজনীতি করে তারা কী এভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে? পারে না। কিন্তু খালেদা জিয়া বসে বসে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”

কানাডার আদালতে বাংলাদেশের বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা বাস্তব, এরা সত্যিই সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে।”

বক্তৃতার এক পর্যায়ে সমবেত প্রবাসীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন- জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কারও মৃত্যু হলে সবচেয়ে বেশি মন খারাপ কার হয়- তা তারা বলতে পারেন কিনা।

উপস্থিত প্রবাসীরা তখন একসঙ্গে বলে ওঠেন, ‘খালেদা জিয়া’। 

শেখ হাসিনা বলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন এবং দেখেছেন, তাদের (জঙ্গিদের) জন্য তারা আকুল হয়ে যান এবং অপপ্রচারগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছড়ায়।”

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে কমিটি করে দেওয়া এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জনমত গড়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র বিদেশি জনপ্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি ‘বিএনপি যে একটি জঙ্গি-সন্ত্রাসী সংগঠন’- এ কথাগুলোও তাদের জানাতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।

সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস-জঙ্গিবিরোধী অবস্থান এবং বিএনপি-জামায়াতের ‘মানুষ পুড়িয়ে হত্যার’ ঘটনাও জানাতে বলেন।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ স্বীকারের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা। 

“আমার একটাই দ্বায়িত্ব, যে জাতির জন্য আমার বাবা, মা ভাই জীবন দিয়ে গেছেন, সে জাতির ভাগ্য আমাকে পরিবর্তন করতেই হবে। সে বাঙালি জাতিকে উন্নত জীবন এনে দিতেই হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, তিনি নিজে ও ছোট বোন শেখ রেহানা তাদের সন্তানদের ‘শিক্ষিত করে মানুষের জন্য কাজ করার উপযুক্ত করে’ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।

“মানুষের জন্য কাজ করার যে শিক্ষাটা আমরা পেয়েছি এবং ছেলেমেয়েদের দিতে পেরেছি, সেটাইতো বড় কথা। তারা দেশের জন্যই কিন্তু কাজ করে। আমি আজ পযন্ত দেখি নাই যে তারা এসে এই ব্যবসা দাও, ওই ব্যবসা দাও বা হাওয়া ভবন খুলে পাওয়া খুঁজে বেড়ানো… অন্তত ওই পর্যায়ে যায় নাই।”     

প্রধানমন্ত্রী তার সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নীতি বাংলাদেশ ভিক্ষা করে নয়, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব, মর্যাদা নিয়ে বাঁচব।”

তিন দিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার রাতে লন্ডন হয়ে স্টকহোমে আসেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সুইডেনে এটাই প্রথম সরকারি সফর।

ছবি-পিআইডি

ছবি-পিআইডি

বৃহস্পতিবার সকালে সুইডিশ পার্লামেন্ট ঘুরে দেখেন শেখ হাসিনা। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সুইডেনের রাজপ্রাসাদে। সেখানে রাজা কার্ল ষষ্ঠদশ গুস্তাভের সঙ্গে তিনি সৌজন্য সাক্ষাত করেন।

এরপর সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়।

সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী জানান, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ‘ফলপ্রসূ’ এবং রাজার সঙ্গে ‘চমৎকার’ আলোচনা হয়েছে।

ছোট বোন শেখ রেহানাও সুইডেন সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন।

সফর শেষে শুক্রবার ঢাকার পথে স্টকহোম ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী। লন্ডন হয়ে শনিবার তার দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।