দুর্ভাগ্য! ষড়যন্ত্রে দলের লোকরাও ছিল: হাসিনা

স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য দলের ভেতরের মানুষদের ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করেছেন শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2017, 11:27 AM
Updated : 17 May 2017, 12:01 PM

স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যায় তৎকালীন মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছেন, “আরও অনেকে এর মধ্যে জড়িত ছিল, এই ষড়যন্ত্রের সাথে।

“আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা (তারা) করে দিয়েছিল।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নিজের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বুধবার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় একথা বলেন শেখ হাসিনা।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

ছয় বছর প্রবাসে থাকার পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাবার দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তারপর এখন তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি বলে জানান তার মেয়ে।

শেখ হাসিনা বলেন, “অনেকেই তাকে সাবধান করেছিলেন; এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বিশ্বাসই করেন নাই। আব্বা বলতেন, ‘না, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে?”

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররাই জাতির জনককে হত্যা করেছিল, বলেন শেখ হাসিনা।

এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকের নিয়মিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

“ডালিম (শরিফুল হক ডালিম), ডালিমের শ্বাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালী ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসায় পড়ে থাকত। ডালিমের শ্বাশুড়ি তো সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত … ডালিমের বউ তো সারাদিনই আমাদের বাসায়।”

নিজের ভাই শেখ কামালের সঙ্গে খুনি মেজর এ এইচ এম বি নূর চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসাবে কাজ করার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

“এরা তো অত্যন্ত চেনা মুখ।”

আরেক খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিকের শালীর ছেলে।

“খুব দূরের না। এরাই ষড়যন্ত্র করল।”

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় দলের নেতৃত্ব থেকে শেখ হাসিনাকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রের জন্যও আওয়ামী লীগ কর্মীদের রোষের শিকার হয়েছিলেন কয়েক নেতা। পরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি তাদের ক্ষমা করে দিলেও ভুলে যাননি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা আবারও বলেন শেখ হাসিনা; যে সেনা কর্মকর্তা তার কয়েক মাসের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন।

তিনি বলেন, “যারা এভাবে বেইমানি করে, মোনাফেকি করে, তারা কিন্তু এভাবে থাকতে পারে না। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। তাদের মধ্যে অবশ্যই যোগসাজশ ছিল।”

জিয়ার পারিবারিক সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান প্রতি সপ্তাহে একদিন তার স্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে ওই ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত।”

বঙ্গবন্ধু বাড়ি দুয়ার সবার জন্য অবারিত ছিল, যার সুযোগ ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল বলে জানান শেখ হাসিনা।

“তাদের যাওয়াটা আন্তরিকতা না.. চক্রান্ত করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য; সেটা বোধ হয় আমরা বুঝতে পারি নাই।”

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আব্বা যখন দেখেছেন, তাকে গুলি করছে, তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া সেনাবাহিনীর সদস্য, তার হাতে গড়া মানুষ.. জানি না তার মনে কী প্রশ্ন জেগেছিল?”

স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা; ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে গিয়েছিলেন বেড়াতে।  

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিন দুই বোন ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। খবর শোনার পর পশ্চিম জার্মানিতে ফিরে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় উঠেন তারা। পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

এক দিনে পরিবারের সবাইকে হারানোর দিনটি মনে করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“তখনও ততটা জানতে পরিনি কী ঘটে গেছে বাংলাদেশে। যখন জানতে পারলাম, তখন সহ্য করাটা কঠিন ছিল।”

ওই সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের পশ্চিম জার্মানির বন শহরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথা চেপে রাখার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

“এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না। উনার কোথায় যাওয়ার কথা ছিল চলে গেলেন। হুমায়ুন রশীদ সাহেব এই হত্যাকাণ্ডকে কনডেম করলেন প্রেসের সামনে।”

বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন শেখ হাসিনার সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতেও ছিলেন। পরে আলাদা দল গড়েন তিনি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পরে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন।

ভারতে নির্বাসিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শেখ হাসিনা বলেন, “ভাবলাম দেশের কাছে যাই। কখনও শুনি, মা বেঁচে আছে। কখনও শুনি, রাসেল বেঁচে আছে। একেক সময় একেক খবর পেতাম। ওই আশা নিয়ে চলে আসলাম। কেউ বেঁচে থাকলে ঠিক পাব।

“২৪ অগাস্ট দিল্লি পৌঁছলাম। মিসেস গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের ডাকলেন। ওনার কাছ থেকে শুনলাম, কেউ বেঁচে নেই। হুমায়ুন রশীদ সাহেব আগে বলেছিলেন। কিন্তু, আমি রেহানাকে বলতে পারি নাই। কারণ, ওর মনে একটা আশা ছিল, কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে।”

 “দিল্লিতে মিসেস গান্ধী থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওয়াজেদ সাহেবকে (এম ওয়াজেদ মিয়া) এটমিক এনার্জিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন।” 

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা কী কষ্টের .. যন্ত্রণার কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।”

অর্থের কারণে ১৯৭৭ সালে বোন শেখ রেহানার বিয়েতে লন্ডনে যেতে না পারার বেদনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাব, অত টাকা ছিল না। আর, কোথায় থাকব?”

১৯৮০ সালে লন্ডনে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

“ওর (শেখ রেহানা) যখন বাচ্চা হবে, আমি মিসেস গান্ধীকে গিয়ে বললাম, আমি যেতে চাই রেহানার কাছে। উনি ব্যবস্থা করে দিলেন। টিকেটের ব্যবস্থা করে দিলেন। থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।”

“৮০ এর শেষে দিল্লিতে ফিরে আসি। টাকাও ছিল না। আর, কার কাছে হাত পাতা.. ভালো লাগত না।”

১৯৮০ সালে বিদেশে থাকার সময়ই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় রাজনীতির বাইরে থাকা শেখ হাসিনাকে। 

তিনি বলেন, “এত বড় সংগঠন করার অভিজ্ঞতাও আমার ছিলে না। আমার চলার পথ অত সহজ ছিল না।”

দল এবং দলের বাইরে নানা প্রতিকূলতার কথা তুলে শেখ হাসিনা বলেন, “খুনিরা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত। স্বাধীনতার বিরোধীরা তখন বহাল তবিয়তে। তারাই ক্ষমতার মালিক। যে পরিবারকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, সে পরিবারের একজন এসে রাজনীতি করবে।

“সেটা এত সহজ ছিল না, প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা ছিল।”

বক্তব্যের এই পর্যায়ে উপস্থিত নেতাদের আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে বলেন শেখ হাসিনা; তবে সবাই সমস্বরে ‘না না’ বলে ওঠেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “নতুন নেতৃত্ব খোঁজা দরকার। জীবন-মৃত্যু আমি পরোয়া করি না। মৃত্যুকে আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমি ভয় পাইনি।

“আমি বিশ্বাস করি, আমার আব্বা আমাকে ছায়ার মতো আমাকে দেখে রাখেন.. আর, উপরে আল্লাহর ছায়া আমি পাই।”

“মেয়ের হাত ধরে দুটা সুটকেস নিয়ে চলে আসি। আমি মনে করি, আমাকে যেতে হবে, কিছু করতে হবে,” ৩৬ বছর আগের এই দিনটিতে দেশে ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।