ভোট ধরে নতুন ছকে ইসলামী দলগুলো

হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘সখিতায়’ ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ভাবনায় নতুন ছকের ইঙ্গিত মিলছে।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2017, 04:28 AM
Updated : 28 April 2017, 09:17 AM

এতদিন এই দলগুলোর বেশিরভাগ বিএনপির সঙ্গে থাকলেও সেই বলয় থেকে বেরিয়ে একটি অংশ আলাদাভাবে ভোট করার পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে।

বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টিও কিছু ইসলামী দলকে জড়ো করে নতুন আরেকটি জোটের পরিকল্পনায় ব্যস্ত।

অন্যদিকে এতদিন ইসলামী দলগুলোকে পাশে রেখে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সমালোচনা সহ্য করে আসা বিএনপি এই ‘গা জ্বলা’ থেকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ওই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করছে।

ভোটের আগে বড় সব দল থেকেই প্রস্তাব পাচ্ছেন বলে ইসলামী দলগুলোর নেতাদের দাবি।

কেন-এই প্রশ্নে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো একটা বড় ফ্যাক্টর।

“দেখবেন, নির্বাচন আসলেই বড় দলগুলো ভোটের প্রত্যাশায় ছক কষে। একটাই কারণ ইসলামী দলগুলোর আলেম-ওলামাদের নিয়ে সারাদেশেই একটা ভোট ব্যাংক আছে।”

আর সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেয়ে সংসদে যাওয়ার গুরুত্ব যে বেশি, তা স্পষ্ট এই দলগুলোর নেতাদের কথায়।

ইসলামী জোটের আরেক অংশের নেতা মুফতি আবদুর রব ইউসুফী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপির সঙ্গে আমরা যারা আছি, সেটা কি ভোটের জন্য নয়?

“বিএনপির গঠনতন্ত্রে তো ইসলামী হুকুমত কায়েম করবে-এমন কোনো ধারা নেই। কাজেই আপনি বুঝতে পারছেন। আমরা চাই, ২০ দলীয় জোটে থাকলে আমাদেরও কিছু এমপি হয়ে আসবেন।”

আবদুর রব ইউসুফীর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পাশাপাশি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকা ইসলামী ঐক্যজোটে রয়েছে নেজামে ইসলাম (এমএ রকীব-আবদুল করীম খান নেতৃত্বাধীন), খেলাফতে রাব্বানী (মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী নেতৃত্বাধীন)। এই ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা এম এ রকীব।

দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী রয়েছে বিএনপি জোটে। এই জোটের অন্য ইসলামী দলগুলো হচ্ছে খেলাফত মজলিশ, ইসলামিক পার্টি, মুসলিম লীগ।

দেড় বছর আগে বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আলাদা ইসলামী দল গড়ার নেতৃত্বদাতা আবদুল লতিফ নেজামী নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান। তার নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্য জোটে রয়েছে খেলাফতে ইসলামী (আবুল হাসনাত আমেনী নেতৃত্বাধীন), ওলামা কমিটি (মুফতি তৈয়ব নেতৃত্বাধীন) ও ফরায়েজী জামায়াত ( আবদুল্লাহ মো. হাসান নেতৃত্বাধীন)।

২০ দলীয় জোটের শক্তি খর্ব করতে আওয়ামী লীগের মদদেই নেজামীরা আলাদা হয়েছেন বলে দাবি করে আসছেন বিএনপি নেতারা।

এই নেজামীই নতুন একটি মোর্চা গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আলাদাভাবে নির্বাচন করা। তিনশ আসনে ভোট করার ঘোষণা আমাদের আছে।”

চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আটরশির পীরের নেতৃত্বাধীন জাকের পার্টি, খেলাফত আন্দোলনের মতো ইসলামী দলগুলো এখনও কোনো জোটে নেই। 

ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে মোর্চার কথা বললেও ভোটের রাজনীতিতে যে আদর্শই শেষ কথা নয়, তা ফুটে উঠল রব ইউসুফীর মতো নেজামীর কথায়ও।

“পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তবে পরিস্থিতি বুঝে কোনো গ্রেটার এলায়েন্সে যাওয়া হবে কি না, এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, সময় বলে দেবে।”

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ নিয়ে পথচলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে সুফীবাদী তরীকত ফেডারেশন ছাড়া কোনো ইসলামী দল নেই।

কওমি মাদ্রাসার সনদের স্নাতকোত্তর স্বীকৃতি এবং হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভোটের আপস হিসেবে দেখছে তার মিত্র দলগুলোরই অনেক নেতা।

তবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাফাই গাইছেন এই বলে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক ‘বাস্তবতা বিবেচনা করে’ এবং জনগণের অনুভূতি ও আবেগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা ‘বাস্তবমুখী’ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদ মাহাবুব-উল আলম হানিফের কথায় স্পষ্ট, তারা ইসলামী দলগুলোর আস্থাভাজন হতে চাইছেন। 

“বিএনপির গায়ে জ্বালা, তারা খুশি হতে পারেনি। কারণ এর ফলে ইসলামপন্থি সব দলে জননেত্রীর প্রতি আস্থা আসবে।”

আওয়ামী লীগের নানা পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও কওমির সনদ নিয়ে সে পথে হাঁটেনি বিএনপি। বরং দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, একাজটি তারাই সরকারে থাকতে করেছিলেন।

তখন বিএনপি জোটে থাকা নেজামে ইসলামের নেতা নেজামী বলেন, চারদলীয় জোট সরকার আমলে এই স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা যায়নি।

২২-২৬% ভোট?

জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরতে ইসলামী দলগুলোর নেতারা নিজেদের হাতে এক-চতুর্থাংশ ভোট থাকার দাবি করেছেন; যদিও তারা জোটের হয়ে অংশ নেওয়ায় ভোটের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর।

আবদুল লতিফ নেজামীর দাবি, বিভিন্ন ভাগে থাকা ইসলামী দলগুলোর হাতে মোট ২২%-২৬% ভোট রয়েছে।

তার দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ১০ কোটি ভোটারের ২ কোটির বেশি ইসলামী দলগুলোকে ভোট দেন।

রব ইউসুফী বলেন, “শতকরা হিসেবে এই সংখ্যা প্রায় ২৪% হবে। এ্টাই ইসলামী দলগুলো মূলভোট, এটাই হেফাজতের ভোট। আলেম-ওলামারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন, তাদেরও সমর্থন এই ২৪% ভোটের পক্ষে থাকবে।”

নতুন ইসলামী মোর্চা গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা নেজামী বলেন, “ভোটের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো একটা ফ্যাক্টর। একে ছোট করে দেখার উপায় নেই।”

বিএনপি জোটে থাকা রব ইউসুফী বলেন, “খেলাফত মজলিশের উভয় গ্রুপ, ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তের উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন- এই দলগুলো যদি কোনো একদিকে থাকে, তাহলে সেই পক্ষের পাল্লা ভারী হবে। এটা যে কোনো বড় দলের ভোটের সমীকরণে প্রভাব ফেলবে।”

ইসলামী দলগুলোর ভোট টানতে এইচ এম এরশাদ ৩৪টি দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে এই দলগুলোর কোনো সক্রিয়তা বা পরিচিতি নেই।

এই ইসলামী মহাজোটের নেতা আবু নাছের ওয়াহেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, আমাদের আলোচনা চলছে।”

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের এই উদ্যোগ। সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের গোছাচ্ছে। আমাদেরও সেই উদ্দেশ্য।”

২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ভোটই চারদলীয় জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল বলে দাবি করেন নেজামী ও ইউসুফী দুজনই।

তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (প্রয়াত) এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনী (প্রয়াত)সহ প্রায় ৫ শতাধিক আলেম-উলামা-মাদ্রাসার ছাত্রদের গ্রেপ্তার করেছিল, হয়রানি করেছিল। সেই কারণেই সারাদেশের ওলামারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল।

তবে এবার রব ইউসুফীরা বিএনপির সঙ্গে থাকলেও লতিফ নেজামীরা আলাদা মোর্চা গঠনের প্রক্রিয়ায়। আর বিএনপি জোটের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নেই বলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না।

ফলে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে।