গালিগালাজ করলে ভারত কিছুই দেবে না: কাদের

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই ভবিষ্যতে অভিন্ন নদীর পানিসহ সবকিছু আদায় করা যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2017, 05:20 PM
Updated : 8 April 2017, 05:29 PM

প্রধানমন্ত্রীর চলমান সফরে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিষয়ে না জেনেই সেগুলোকে দেশবিরোধী বলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনাও করেন তিনি।

শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের।

তিনি বলেন, “বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে আমরা তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি আদায় করব। ইনশাআল্লাহ, অগ্রগতি হয়েছে; প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আরো অগ্রগতি হবে, পজিটিভলি, এটা এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে পারব।

“বন্ধুত্ব রাখতে হবে, গালিগালাজ করলে ইন্ডিয়া কিছুই দেবে না, আপনি কী করবেন? আপনি গালিগালাজ করবেন, তাদের কাছ থেকে সুবিধাও চাইবেন, এটা তো হয় না। ন্যায্য পাওনা হলেও দেশে দেশে দেখবেন, গায়ে জোরে দখল করে রাখছে। ভারত তো সেটা করেনি।”

পঁচাত্তরের পর দেশে ‘ভারত বিদ্বেষ’ ও ‘ইন্ডিয়াফোবিয়া’ তৈরি করে সংশয় অবিশ্বাসে দেয়াল তোলায় দুই দেশের সম্পর্ক না এগোলেও বর্তমান সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই ৪১ বছর ধরে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, ছিটমহল বিনিময় ও সমুদ্র সীমা বুঝে পাওয়া গেছে বলে ভাষ্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের।

কাদের বলেন, “ওখানে নরেন্দ্র মোদীর মতো ডেমোক্রেটিক লিডার, জনপ্রিয় নেতা, প্রাগমেটিক লিডার এবং বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো আধুনিক মনস্ক নেতা, দেশপ্রেমিক নেতা, বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় ছিলেন বলে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন শুধু হয়নি, দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল ঘটনা ঘটেছে।

“সুষ্ঠুভাবে সব সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ৩৫টা ইউপিতে (বিনিময় করা ছিটমহলের ভূখণ্ডগুলোয়) নির্বাচনও হয়েছে। এটা কী কোনো দেশে হয়েছে? ওখানে নরেন্দ্র মোদী ও এখানে শেখ হাসিনা ছিলেন, এটা সম্ভব হয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী কাদের বলেন, “এখন আমরা এটাও ভুলে যাই, একাত্তর সালে ভারত যদি পাশে না থাকত, সেদিন কী হতো আমাদের। শরণার্থীদের কী হতো, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কী হতো এবং ইন্টারন্যাশনালি ইন্দিরা গান্ধী সলিডারিটি ক্যাম্পেইন সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন; সেটার তো দরকার ছিল। কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্য রক্ত দিয়েছিল্।

“এটা আমরা ভুলতে পারি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা সব ভুলে গেলাম। ২১ বছর ধরে ভারত বিদ্বেষ, ইণ্ডিয়াফোবিয়া সৃষ্টি করে সংশয় অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে ফেলা হয়েছিল। কোনো ন্যায্য পাওনা আমরা আদায় করতে পারিনি। শত্রুতা করে দাবি আদায় করা যায় না। বন্ধুত্ব করে আলাপ আলোচনা ভিত্তিতে দাবি, ন্যায্য পাওনা আদায় সম্ভব। তার প্রমাণ সীমান্ত চুক্তির ৪১ বছর পরে বাস্তবায়ন।”

আন্তর্জাতিক আদালতে আরবিট্রেশানে জয়ী হয়ে সমুদ্র সীমার রায় বাংলাদেশ অনুকূলে পেলেও ভারত তা বুঝিয়ে না দিলে কিছুর করার ছিল না বলে ভাষ্য সেতুমন্ত্রীর।

“কী করতাম আমরা, যদি সমুদ্র সীমা ভারত আমাদের বুঝিয়ে না দিত? আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে গেছি, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ভারত নিদ্বিধায় মেনে নেয়; সেকারণ আমাদের সমুদ্র সীমা, আমাদের পাওনা বুঝে নিয়েছি।

“যদি আমরা আগে মতো শত্রুতায়, বৈরিতায় থাকতাম, তাহলে কী আমরা এই বিশাল সমস্যার সমাধান আমরা কী করতে পারতাম।”

বিএনপি মহাসচিব ভারতের সঙ্গে চুক্তিকে দেশবিরোধী বলার প্রেক্ষাপটে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্ধকারে ঢিল ছুড়েন বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক।

শনিবার সকালের এই অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, “মির্জা ফখরুল সাহেব অন্ধকারে ঢিল ছুড়বেন না, চুক্তি দেশবিরোধী নয়, জনগণের স্বার্থে হবে। মির্জা ফখরুল সাহেব মাঝে মাঝে অন্ধাকারে ঢিল ছুড়েন।

“প্রধানমন্ত্রী গেলেন ভারতে, এখনও কোনো চুক্তিই হল না, আলাপ আলোচনাও হল না, হয়তো আজ কিছু হবে, আগামীকাল হবে। চুক্তিটা হওয়ার আগে আপনি চুক্তিকে দেশবিরোধী বলছেন কেমন করে? আপনি কী দেখলেন, চুক্তিতে কী আছে; আগে চুক্তি দেখুন, দেখার আগে অন্ধকারে ঢিল ছুড়বেন না।”

অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে স্বাক্ষরিত সব চুক্তির বিষয়ে কোনো কিছু গোপন রাখা হবে বলেও জানান সেতুমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর চারদিনের ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে প্রায় তিন ডজন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি, যাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা।

তবে নয়া দিল্লিতে দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, দুই এদেশের বিদ্যমান সরকারই এই জট খুলতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হায়দ্রাবাদ হাউজে মোদীর এই ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও, যার কারণে দুই দেশের এই চুক্তি ঝুলে আছে ছয় বছর ধরে।

তিস্তার জট কাটানোর লক্ষ্যে মোদীর উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে শীর্ষ বৈঠকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হয়। খুলনা-কলকাতা বাস ও ট্রেন উদ্বোধনে তাকেও সঙ্গে রাখেন মোদী।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। এরপর ক্ষমতার পালাবদলে মোদী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে এলেও এখনও তিস্তার জট খুলতে পারেননি।

ভারত মমতার দোহাই দিয়ে তিস্তার বিষয়টি ঝুঁলিয়ে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছ থেকে নিজেদের সব স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে বলে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে।

এবিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “সেখানে তাদের ইন্টারনাল কিছু প্রবলেম আছে। পানির বিষয়ে রাজ্যের একটা ব্যাপার আছে। পানিটা রাজ্যে সংবিধানের একটা অংশে লেখা আছে। আবার আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পানি কেন্দ্রের বিষয় হলেও ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, তারা রাজ্যকে হোস্টেইল করে কিছু করতে চায় না। করা উচিত নয়, এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে।”

“সব বিষয়গুলোকে একসঙ্গে নিয়ে একটা প্যাকেজ ডিল হবে; পিস পিস করে এখানে লাভ নেই। সেটার জন্য একটু সময় দেরি হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টায় পিছিয়ে যাচ্ছে না, না করে দিচ্ছে না। না তো করবেই না, ওইটা করার জন্য মানসিকভাবে উভয় দেশ, উভয় সরকার প্রস্তুত।”

ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার ও পংকজ দেবনাথসহ পরিষদের নেতারা ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কাউন্সিলর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।