ভরসা রাখুন, নৌকায় ভোট দিন: হাসিনা

আওয়ামী লীগের উপর ভরসা রেখে পরবর্তী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রিয়াজুল বাশারও সাইফুল তসলিম, লক্ষ্মীপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2017, 01:30 PM
Updated : 14 March 2017, 02:37 PM

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০ বছর পর মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুরে গিয়ে জনসভায় এই আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, “জনগণের কল্যাণে কাজ চাইলে কাজ করা যায় সেটা আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কাছে চাইতে হয় না। কারণ আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে; আওয়ামী লীগ জানে জনগণের কিসে উন্নতি হয়।

“কাজেই আওয়ামী লীগের ওপর আপনারা ভরসা রাখবেন এবং ২০০৮ ও ২০১৪ সালে যেভাবে আপনারা ভোট দিয়েছেন ঠিক সেইভাবে আগামীতে যত নির্বাচন আসবে প্রত্যেক নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আপনাদের সেবা করার সুযোগ করে দেবেন সেটাই আমরা আশা করি।”

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নেওয়ার লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আপনাদের দোয়া চাই, ভালোবাসা চাই আর প্রতিটা নির্বাচনে নৌকা মার্কায় আপনাদের ভোট চাই।”

এসময় তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, “আপনারা নৌকায় ভোট দেবেন?”

জবাবে হাত উঁচিয়ে সমস্বরে সাড়া দেন উপস্থিত জনতা।

হেলিকপ্টারে করে দুপুরে লক্ষ্মীপুর পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। সার্কিট হাউজে কিছুক্ষণ অবস্থান করে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে স্টেডিয়ামে পৌঁছে প্রথমেই জেলার ১০টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ১৭টি প্রকল্পের ভিত্তি ফলক উন্মোচন করেন।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে লক্ষ্মীপুর শহর ও আশপাশের এলাকা পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানারে ছেয়ে যায়, নির্মাণ করা হয় বহু তোরণ।

জনসভায় আগতদের সমাবেশ স্টেডিয়ামের গ্যালারি ও মাঠ ভরে আশপাশের এলাকা ও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই- এদেশ উন্নত হোক, সমৃদ্ধশালী হোক। ইনশাল্লাহ আমরা তা করতে পারব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব।”

গত আট বছরে তার শাসনামলে পাঁচ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে একটা মানুষও দরিদ্র থাকবে না। প্রত্যেকটা মানুষ যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।”

ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে দিতে। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্যের বিষয়। মানুষকে হত্যা করা, খুন করা, দুর্নীতি করা, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা এটাই তাদের চরিত্র। এমনকি এতিমখানা থেকেও টাকা চুরি করে খায়।

“বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস সৃষ্টি করা। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা।” 

২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালের রায়ে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত এবং ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বিএনপি-জামায়াতের ‘সহিংসতার’ সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।

ওই আন্দোলনে গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনারা নিজেরা চিন্তা করে দেখেন, কোনও মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে কি না। ওই খালেদা জিয়া গুলশানের এয়ারকন্ডিশনড অফিসে বসে হুকুম দিয়েছে, আর তার এক ছেলে কুলাঙ্গার বিদেশে বসে হুকুম দিয়েছে এবং এখানে তাদের ক্যাডাররা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে।

“তাদের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।”

ইসলামকে শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে ছেলে-মেয়েরা যেন জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের পথে না যায় সে বিষয়ে প্রতিটি এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিশেষভাবে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে বলে নাই। যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা বেহেস্তে যায় না, দোজোখে যায়।”

বিএনপি ‘ধর্মেও বিশ্বাস করে না’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “বায়তুল মোকাররমে শত শত কোরআন শরীফ পুড়িয়েছে। মসজিদে আগুন দিয়েছে।

“যারা এভাবে মানুষ খুন করে, কোরআন শরীফ পোড়ায়, যারা মসজিদে আগুন দেয় তারা কিসের ধর্ম বিশ্বাস করেন, কিসের জনগণের কল্যাণ করেন? ওই বিএনপি নেত্রী হুকুম দিয়ে দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মসজিদ কমপ্লেক্স ও ইসলামি সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে তুলবে।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিএনপিও ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু কিছুই করতে পারে নাই।”      

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাবা, মা, ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “একটা কথা আপনাদের পরিষ্কার করে বলতে চাই- আমার নিজের জীবনে ব্যক্তিগত কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। কারণ আমিতো সব হারিয়েছি। আমার বাবা, মা, ভাইদের হত্যা করেছে।

“পিতা, মাতা, ভাইদের সব হারিয়ে আমি বাংলাদেশে এসেছি শুধু আপনাদের কাছে, বাংলার জনগণের কাছে। কারণ আপনাদের মাঝেই আমি খুঁজে পেয়েছি হারানো বাবা, মায়ের স্নেহ এবং ভাইয়ের ভালোবাসা। আপনাদের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করেছি।”

প্রয়োজনে বাবার মতো নিজেও জীবন দিতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।  

তিনি বলেন, “এই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, এই বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে গিয়ে আমার বাবা, মা, ভাইয়েরা জীবন দিয়ে গেছেন।

“আমি আমার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছি আপনাদের স্বার্থে, কল্যাণে,

আপনাদের উন্নয়নে। যদি প্রয়োজন হয় বাবার মতো জীবন দিয়ে আপনাদের ভাগ্যকে পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলব-এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সরকারি উদ্যোগে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণ করা হচ্ছে।

এছাড়া বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষায় বিনামূল্যে ৩৬ কোটির বেশি বই বিতরণ, কৃষিতে ভর্তুকি ও বিনামূল্যে উপকরণ সরবরাহ, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন ও মোবাইল সেবা সহজলভ্য করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে ডিজিটাল সুবিধা নিয়ে যেতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ‘লক্ষ্মীপুরবাসীর জন্য কিছুই করে নাই’ মন্তব্য করে ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আপনাদের এখানে খালি হাতে আসিনি। উপহার নিয়ে এসেছি।”

সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় লক্ষ্মীপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। 

যেসব প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তি ফলক উন্মোচন

যে প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করা হয়েছে সেগুলো হল- রামগতি ও কমলনগর মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদ ভবন, সদর উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম, কমলনগর উপজেলা পরিষদ ভবন, কমলনগর উপজেলা অডিটোরিয়াম, লক্ষ্মীপুর পৌর আইডিয়াল কলেজ ভবন, মোহাম্মদিয়া বাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র নির্মাণ (তৃতীয় ও চতুর্থ), কমলনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও প্রাণি হাসপাতাল উন্নয়ন প্রকল্প।

ভিত্তি স্থাপন করেছেন- ২৫০ শয্যার হাসপাতাল, মজু চৌধুরী হাটে কোস্ট গার্ডের প্রশাসনিক ভবন ও নাবিক নিবাস, পুলিশ অফিসার্স মেস, লক্ষ্মীপুর সদর পুলিশ ফাঁড়ি, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ভবন, ৫০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার নতুন গুদাম, রামগঞ্জ উপজেলায় ১৩২/৩৩ কেবি গ্রিড উপ-কেন্দ্র, পিয়ারাপুর সেতু, চেউয়াখালী সেতু, মজু চৌধুরীর হাটে নৌবন্দর, লক্ষ্মীপুর পৌর আধুনিক বিপণিবিতান, রামগঞ্জে আনসার ও ভিডিপি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর কমপ্লেক্স, লক্ষ্মীপুর পৌর আজিম শাহ (রা.) হকার্স মার্কেট, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ একাডেমিক ভবন কাম পরীক্ষা কেন্দ্র, লক্ষ্মীপুর পুলিশ লাইন্স মহিলা ব্যারাক নির্মাণ, লক্ষ্মীপুর শহর সংযোগ সড়কে পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ, রায়পুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন ও কমলনগর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকুর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের সঞ্চালনায় জনসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুর নাহার লাইলি, স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহজাহান কামাল ও পৌর মেয়র এম এ তাহের।