বিএনপির রাজনীতির সমালোচনায় সাবেক-বর্তমান ৩ নেতা   

বিএনপির রাজনৈতিক ‘নিষ্ক্রিয়তা’ নিয়ে যে কথা এতদিন আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছিলেন, সেই একই কথা ক্ষোভের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় তুলে ধরলেন খালেদা জিয়ার দলের সাবেক-বর্তমান তিন নেতা।     

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2017, 02:07 PM
Updated : 20 Jan 2017, 02:31 PM

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে শুক্রবার ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের উপস্থিতিতেই দলটির নতুন কমিটিতে পদ না পাওয়া একজন অভিযোগ করেন, এবার কমিটি করার সময় টাকা দিয়ে পদ পেয়েছেন অনেকে।

বিএনপির গত কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, বিএনপির ভোট ব্যাংক অক্ষুণ্ন আছে, কিন্তু কাজে লাগাতে পারছেন না।

“জান কোরবান করে যারা রাজপথে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। মাঠে কি করলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কি আছে, নেতৃত্বের প্রতি আপনার কি আনুগত্য আছে সেগুলো বিএনপিতে বিচার করা হচ্ছে না, বিচার করা হচ্ছে টাকা, শোনা যায় দেখি নাই।… টাকা দিলে নাকি বিএনপিতে বড় বড় পদ পাওয়া যায়।

“আজকে কি বিএনপি আছে বলে মনে হয়? ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ডিআরইউ ছাড়া বিএনপিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়?”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কটাক্ষ করে বলেন, “বিএনপি কর্মসূচি দেয় কিন্তু নেতারা ঘরে শুয়ে শুয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। তারা কেউ বাইরে যায় না, রাস্তায় বের হয় না। তাহলে কর্মীরা কী করে আন্দোলনে শরীক হবে?”

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে মহিউদ্দিন খান মোহন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর প্রসঙ্গ আনেন।

“আছেন একজন আবাসিক কাম সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, প্রতিদিন ব্রিফিং করতে হবে কেন? লোকজন এখন হাসিঠাট্টা করে। আওয়ামী লীগের লোকজন বলেন, বিএনপি মানে ব্রিফিং অ্যান্ড নিউজ পার্টি। বিএনপিকে ব্রিফিংয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ওখান থেকে বের করা যাচ্ছে না।”

বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও গত ১৪ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে রিজভীকে সংবাদ সম্মেলন করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।

গতবছর অগাস্টে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করার পর তাতে নাম না আসায় খালেদা জিয়ার এক সময়ের সহকারী প্রেস সচিব মহিউদ্দিন খান মোহন পদত‌্যাগের ঘোষণা দেন বলে সে সময় সংবাদপত্রে খবর আসে।  

২০১৫ সালে ঢাকায় ‘অপহরণ’ নাটকীয়তার পর ভারতে আবির্ভূত হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বিচারাধীন বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনকে এবার যুগ্ম মহাসচিব থেকে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে আনা হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মোহন।

“কয়েকদিন ভিডিও বার্তায় টেলিভিশনের ম্যাসেজ দিয়ে অন্তর্ধান হয়ে শিলংয়ে গিয়ে উদয় হলেন, কোনো যোগ্যতা নাই তারে বানিয়ে দিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য। কী যোগ্যতা আছে উনার স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ায়? উনি তো অস্থায়ীভাবে ভারতে আছেন, এখানে স্থায়ী কমিটি সদস্য। কীসব কাণ্ড ঘটছে বিএনপিতে?”

ক্ষমতায় গেলে ঢাকা সিটির নাম পরিবর্তন করে ‘জিয়া সিটি’ করার ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর সমালোচনা করে মোহন বলেন, “এর থেকে বালখিল্য কথা আর হয় না।”

ঢাকার নামকরণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, “ঢাকাকে জিয়া সিটি করার কথা বলে দুদু সাহেব জিয়াউর রহমানকে খাটো করেছেন। … আওয়ামী লীগ যে কালচারে বিশ্বাস করে বিএনপিতো সেই কালচারকে বিশ্বাস করতে পারে না।”

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রফিক সিকদার বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটাতে হবে, রাজপথে আন্দোলন দিতে হবে।

“যারা ত্যাগী, যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের আরও বেশি করে মূল্যায়ন করেন। যার যেটি পাওনা সেটি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করলে আগামী দিনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

“আমাকে সারা বছর কাজ করানোর পরে আমার শ্রমের মূল্য যদি আপনি আরেকজনকে দিয়ে দেন, আমার বেতন যদি আমাকে না দেন, আমাকে যদি বঞ্চিত করেন, আমার পেটে যদি লাথি দেন আমি যেমন কষ্ট পাব আরও যারা কষ্ট করেছেন তারাও কষ্ট পাবে।”

‘কাজ ছাড়াই পুরস্কৃত হলে’ কেউ কাজ করবে না মন্তব্য করে রফিক বলেন, “এই বৈষ্যম্যের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে হবে, রাজনীতিবিদদের দিয়ে রাজনীতি করাতে হবে।”

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, “বিএনপির বড় বড় নেতারা একটা সময় মনে করতেন একটা-দুইটা ধানের শীষ বিক্রি করলে কি এমন ক্ষতি। দেখা যেত আমলারা সেই জায়গায় স্থান পেয়েছে। আমলারা কোনোভাবে কাউকে সন্তুষ্ট করে নমিনেশন নিয়েছে, পাস করেছে।”

এবার কেন্দ্রীয় কমিটি কেন ৬০০ সদস্যের হল- সেই প্রশ্ন তুলে মনি বলেন, “দলের মনোনয়ন না হয় বিক্রি হল, সেটা আলাদা জিনিস। কিন্তু দলের পদ, মাকে যখন কেউ বাজারে বিক্রি করে সেই সংসার বলতে আর কিছু থাকে না। সেই মানুষকে কেউ মানুষ বলে না, তাকে অমানুষই বলা হয়।”

ওবায়দুল কাদেরের কটাক্ষের প্রসঙ্গ টেনে মনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যাত্রাপালার মত কথা বলেন, যখন বিএনপি নিয়ে বলেন আরও বেশি যাত্রাপালার মত হয়ে যায়। উনি বলেছেন, বিএনপিতে যে ৬০০ সদস্য আছে তারা কি কখনও একসঙ্গে একটা মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন?”

দলের নেতাকর্মীরা খুন, গুম হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন জেলে থ্কলেও কেন্দ্রীয় বড় নেতারা এ নিয়ে চুপ থাকছেন বলে অভিযোগ করেন মনি।

আর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, এ অনুষ্ঠানে নেতাদের মুখ থেকে দলের সমালোচা শুনে তিনি অভিভূত।

“রাজনীতির ক্ষেত্রে এতটা সরল ও গভীর অনুধ্যান, গভীর বোধ তৈরি করতে পারে, রাজনীতি বলতে যে একটা দর্শন আছে তা তারা স্পর্শ করতে পেরেছেন, এগুলো আমাদের জন্য অনুকরণীয়।”

বিএনপিতে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি ও কৌশলগত দিকের ‘অভাব আছে’ মন্তব্য করে সুকোমল বড়ুয়া বলেন, দলে গবেষণা প্রয়োজন, তৃণমূলে রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে কর্মীদের খোঁজ-খবরও রাখতে হবে।

সবার বক্তব্য শুনে নোমান বলেন, “রাজনৈতিক কারণে আলোচকবৃন্দ তাদের মনের মধ্যে যে দুঃখ-বেদনা তা প্রকাশ করেছেন। তাই অ্যাকডেমিক লাইনে এই আলোচনা নিয়ে যেতে পারি নাই।

“যারা আলোচনা করেছেন, বিবেকের তাড়নায় তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিজেদের সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করা কঠিন ব্যাপার। আত্মসমালোচনাকে অনেকে ব্যক্তিগত সমালোচনা হিসেবে গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। আজকে সাহসিকতার সাথে যারা আলোচনা করেছেন, তাদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।”

নোমান বলেন, “ভোটের জন্য আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ভোটের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন সেই দাবি তুললেই বলা হচ্ছে বিএনপি রাজনৈতিক শক্তিতে শক্তিমান না, একথা আমাদের শুনতে হচ্ছে।”

বাংলাদেশ নিউ জেনারেশন পার্টি (বিএনজিপি) আয়োজিত ‘রাজনীতিতে সুস্থ্যধারা ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক এ আলোচনা সভায় নোমান ‘জনগণের আস্থাভাজন ও নিরপক্ষ’ নির্বাচন কমিশন গঠনেরও দাবি জানান।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপিজির সভাপতি জাহিদ ইকবাল।