অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রার্থীদের আশ্বস্ত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচনে যাওয়া নগরীকে ‘অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন তারা।
বৃহস্পতিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রার্থী ও সিইসিসহ সরকারি কর্তাব্যক্তিদের এমন বক্তব্য আসে।
প্রার্থীদের বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে সিইসি বলেন, “এখানে সবাই বলেছেন, তারা কেউ মারামারির পক্ষে নন, হানাহানির পক্ষে নন। কাজে যারাই দুষ্কর্ম করবে তাদের যথাযথ শাস্তির বিধান করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা কোনো ছাড় দেব না।”
সভায় সাত মেয়র প্রার্থীর বক্তব্যে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ রাখার কথা আসে; বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান সেনা মোতায়েনের দাবি তোলেন।
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০১১ সালের মতো এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে ‘কমিশন চাইলে যে কোনো বাহিনী মোতায়েন করতে পারে’ মন্তব্য করেন।
আইভী বলেন, “একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, বিএনপি প্রার্থীর যে অভিযোগ সেটা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আমি কারও কোনো ফেভার নিয়ে নির্বাচন করতে চাই না।
“নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে কোনো বাহিনীর যদি আপনাদের প্রয়োজন হয়, আপনারা মোতায়েন করবেন, আপনাদের কাছে আমি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছি।”
২০১১ সালের ৩০ অক্টোবরের মতো এবারের নির্বাচনকেও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে আমার পোলিং এজেন্ট ছিল না। কিন্তু পাবলিক যে ভোটটা দিয়েছিল প্রিজাইডিং অফিসার গণনা করে সেটার আমার ভোট হিসাবে যোগ করেছিলেন। অনেক কেন্দ্রে আমার পোলিং এজেন্ট থাকলেও বলতে পারে নাই পোলিং এজেন্ট।”
কালোটাকার প্রভাব ঠেকাতে ২৭টি ওয়ার্ডের ২৭টি মোবাইল কোর্ট টিমকে রাতের বেলায়ও সক্রিয় রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “রাত্রে কালোটাকার ছড়াছড়ি কাউন্সিলের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। ১৯, ২০, ২১ তারিখ রাতেও যেন মোবাইল কোর্ট টিম সক্রিয় থাকে।”
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “মানুষের মধ্যে একটা শঙ্কা দেখেছি, তাদের যেন প্রভাব বিস্তার করা না হয়। ভোটারদের যাতে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধার সৃষ্টি করা না হয়। তাদেরকে যাতে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করা না হয়, তারা যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা হয়।
“এখানে যারা বক্তব্য রেখেছেন তাদের সবাই বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা শান্তিপূর্ণ রাখা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে গুরুত্ব বিবেচনা করে এই পুলিশ-র্যা বের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের মতো একটি জায়গায় সুষ্ঠু, সুন্দর ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে এখানে মোতায়েন করবেন, সেটার জোর দাবি জানাচ্ছি।”
আইন অনুযায়ী 'অনেক শক্তিশালী’ কমিশনকে আইন প্রয়োগের স্বদিচ্ছা দেখানোর আহ্বান জানান বিএনপির এই মেয়র প্রার্থী।
এখনও পর্যন্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি অভিযোগ করে সাখাওয়াত বলেন, “আমাদের কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের খোঁজা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা কয়েকটি অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।”
সরকারি কর্মকর্তা, আনসার সদস্য এবং পর্যবেক্ষণের নামে কেউ যেন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে বিষয়ে কমিশনকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির প্রার্থী।
“সরকারি কর্মকর্তারা যদি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটায়, অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে তাদের বিরুদ্ধে যেন নির্বাচন কমিশন আইনের ৮১ ধারা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়”, বলেন তিনি।
পোলিং এজেন্টের নাম নির্বাচনের দিনের আগে জমা দিলে তাদের ভয়ভীতি দেখানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেন সাখাওয়াত।
পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হলে সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সামনে যেন ভোট গণনা করা হয়। সব পোলিং এজেন্টের স্বাক্ষর নিয়ে কেন্দ্রেই যেন ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
তাদের বক্তব্যের জবাবে সিইসি রকিবউদ্দীন বলেন, “আপনারা আশ্বস্ত হোন, একটিমাত্র নির্বাচন হচ্ছে, সারাদেশে আর কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। আমার কাছে অনেক ফোর্সেস অ্যাভেলেভল আছে। মোবাইল কোর্টের সংখ্যাও প্রয়োজনবোধে বাড়ানো হবে।”
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে উদ্দেশ করে সিইসি বলেন, “আপনারা সকল সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবেন। তবে, অযথা কেউ যেন হয়রানি না হন, সে ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিও যেন হয়রানির শিকার না হন।
“এই নির্বাচনকে আমরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এ কারণে আমরা সবাই এখানে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে যা করার তা করা হবে। সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলবাহিনী আমরা মোতায়েন করব।”
কাজী রকিব বলেন, “নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপুর্ণ পরিবেশ সব সময়ে মেনটেইন করতে হবে। কেবল ভোটের দিন নয়, তার আগের দিন থেকে আমার মালপত্র ভোটকেন্দ্রে পৌঁছানোর পর থেকে সারারাত্রি পাহারা দিতে হবে।
“কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা আমরা বরদাস্ত করব না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমার নির্দেশ, তারা যেন দুষ্কৃতিকারীদেরকে দৃষ্কৃতকারী বলেই মনে করে। তারা যেন কাউকে প্রশ্রয় না দেয়।”
ভোটকেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশে বিএনপি প্রার্থী দাবি প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, “আমাদের আইনেই আছে ভোটকেন্দ্রেই ফলাফল প্রকাশ করতে হবে, আমরা করিও তা। এবারও কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। প্রিজাইডিং অফিসারদেরকে সেটা প্রতিপালনের কথা পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
রিটার্নিং অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে অভিযোগ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা ঢালাও অভিযোগ করবেন না। সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দেবেন, যাতে আমরা আইন মোতাবেক দ্রুত প্রতিকার করতে পারি। আমরা অত্যন্ত সচেষ্ট। কী ঘটনা, কে করেছে সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন।”
প্রতিটি অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন কাজী রকিবউদ্দীন। একই সঙ্গে বানোয়াট অভিযোগ দিলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
পোলিং এজেন্ট নিয়ে বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, “কোনো সেন্টারে পোলিং এজেন্টকে যেন ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া না হয়। এ বিষয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাগণ এবং আইনশৃঙ্খলবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।”
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোনো ছাড় দেওয়া মন্তব্য করে ২৭টি ওয়ার্ডে ২৭টি মোবাইল কোর্ট দায়িত্ব পালন করার কথা জানান সিইসি।
“প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করব। শেষ কয়েকদিনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও অংশগ্রহণ করবেন”, বলেন তিনি।
কালো টাকা ব্যবহার নিয়ে আইভীর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে সিইসি বলেন, “নিজেরা কালো টাকার ব্যবহার করবেন না, কেউ করলে আপনারা জানাবেন। আমরা রাতের বেলায় পাহারা বজায় রাখব। কোনো ধরনের খবর পেলে রেইড করব, যাতে কেউ কারচুপির করতে না পারে।”
জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়ার সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার হেলাল উদ্দিন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, রিটার্নিং কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার, পুলিশ সুপার মইনুল হক, বিজিবির ৩৯ ব্যাটালিয়নের প্রধান শামীম ইফতেখার, র্যা ব-১১ এর অধিনায়ক কামরুল আহসান এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ৭ মেয়র প্রার্থী বক্তব্য দেন।
গণসংযোগে ব্যস্ত সময়
সকালে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভায় যোগ দেওয়ার বিকালে গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রচারে নামেন বন্দর থানা এলাকার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে।
সেখানে নবীগঞ্জ, বাগে জান্নাত, কদমরসুল, কবিরের মোড়, হাটের ঘাট, ইস্পাহানি, একরামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চান সদ্য বিদায়ী এ মেয়র।
গণসংযোগের ফাঁকে আইভী সাংবাদিকদের বলেন, “আমি উন্নয়ন করার সময় দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছি। তাই নির্বাচনে মানুষ আমাকে দল মতের বাইরে গিয়েই গণ রায় আসবে।”
বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান প্রচারণা চালান নগরীর ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
সেখানে দেওভোগ, বাবুরাইল, বেপারীপাড়া, বৌবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ধানের শীষে ভোট চান সাত খুন মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসাবে পরিচিতি পাওয়া এই আইনজীবী।
এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সবার মধ্যে মধ্যে একটি আশঙ্কা তারা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা। আমরা ভোটাদের আশ্বস্ত করছি। যেন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করেন। বর্তমান যে পরিবেশ তাতে আমি খুব ভালো বলব না। তবে এটি মন্দের ভালো।”