সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে: রিজভী

জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর কথা বলে সরকার ‘দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2016, 01:05 PM
Updated : 4 Dec 2016, 01:05 PM

রোববার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “ওই ‘চাঁন-তারা’ ডিজাইন নিয়ে পার্লামেন্ট ও লেক- আপনি সেটা পরিবর্তন করতে চান না। লুই আই কানের ম্যাপ নিয়ে এসে আপনি অশুভ ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চান, বাস্তবায়ন করতে চান। জিয়াউর রহমানের মাজারকে আপনি সেখান থেকে ধ্বংস করতে চান।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, আপনি অনিবার্য গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষের মণি কোঠায় জিয়াউর রহমানের প্রতি যে শ্রদ্ধা আছে, আপনার ষড়যন্ত্র, আপনার র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে সেটাকে আপনি কখনোই দমন করতে পারবেন না।”

মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের নকশা ভেঙে সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবরসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়। মূল নকশা পাওয়ার পর সেগুলো সরানো হবে বলে জানিয়েছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সম্প্রতি ওই নকশার অনুলিপি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আনা হয়েছে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক কল্যাণ পার্টির নবম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। সেজন্য একটা যোগ্য সাহসী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন চাই।

“আমরা বলতে চাই, যে নির্বাচন কমিশন আছে, তা ঠিক না। এই ধরনের কমিশন গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। কিন্তু তারা জানে, যদি এরকম নির্বাচন কমিশন না হয়, এই রকম নির্বাচন না হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেজন্য দেশনেত্রীর প্রস্তাবের পর তারা বললেন, এটা অন্তঃসারশূন্য।

“এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা বার বার তাদের (ক্ষমতাসীন দল) এ রকম খেলার সুযোগ দেব কি না। এই রকম পরিস্থিতি চলতে পারে না। চলতে পারে না বলেই আন্দোলন-সংগ্রাম হবে। আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে।”

জিয়াউর রহমানের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে রিজভী বলেন, “একাত্তরে যে দায়িত্বটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর পিতার, সেই দায়িত্বটি যখন পালন করেননি তিনি, সেই সময়ের একজন মেজর সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন- স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন মেজর জিয়াউর রহমান। এটা আপনি (প্রধানমন্ত্রী) সহ্য করতে পারছেন না। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদকে ( প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী) সহ্য করতে পারেননি আপনার পিতা। সেজন্য এক-দেড় বছরের মাথায় তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান সিনিয়র হওয়ার পরও তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়নি। তাই আপনারা তাদের সহ্য করতে পারেন না। এজন্যই এই এসব ষড়যন্ত্র।

“আমার মনে হয়, এখানে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করছে। কেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, কেন তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন? সেজন্য আজ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষোভ, তার প্রতিহিংসা অব্যাহত রেখেছেন। এভাবে আপনি যেটা করতে চাচ্ছেন সেটা কোনোদিনও বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।”

সরকারকে সতর্ক করে বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, “এই দেশ ভুটান নয়, সিকিমও নয়। এটা ১৬ কোটি মানুষের দেশ, তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবেন না।”

মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারের নীতির সমালোচনা করে গণস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “বাঘা পুরুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গারা এসছিল, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিলেন- ওদেরকে ফেরত নাও, তা না হলে প্রয়োজনীয় যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ১৯৭৮ সালেও জিয়াও একইভাবে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেছিলেন।

“আজকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলছেন, যে কোনোভাবে তোমাদেরকে (রোহিঙ্গা) ফেরত পাঠিয়ে দেব। কী লজ্জার! এখন আমরা নিরীহ মানুষের দিকে বন্দুক তাক করে রাখি। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, মানবতার খাতিরে আজকে তাদের আশ্রয় দিতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭১ সালে বার্মাতেও (মিয়ানমার) প্রায় ৪০/৫০ হাজার বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিল, ভারতে আরও বেশি বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিল।”

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বলে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ২০ থেকে এখন ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছেন। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

“এই ১০ শতাংশের মধ্যে আমাদের ১০০ জন সচিবের মধ্যে প্রায় ৩০ জন সচিব আছেন সংখ্যালঘু। তার মানে আমাদের অসাম্প্রদায়িক হিসেবে সুনাম আছে। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও মুন্সীগঞ্জের আলী কদম প্রভৃতি থানার ওসিরাও সংখ্যালঘু। আমাদের প্রধান বিচারপতিও সংখ্যালঘু। আমাদের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীতে সংখ্যালঘু রয়েছেন। তবে এই সংখ্যা ১০ শতাংশ না, আরও বেশি হতে হবে।”

তার বক্তব্যের সূত্র ধরে রুহুল কবির রিজভী বলেন, “আজকে ৩০ জন সচিব ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই কেবল নন,  প্রায় ২০ থেকে ৪০ জন ডিসি (জেলা প্রশাসক) হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমরা অসাম্প্রদায়িক দেশ।

“সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিম বাংলায় মুসলমান হচ্ছে সরকারিভাবে ২৫ শতাংশ এবং বেসরকারিভাবে ৩০ শতাংশ। সেখানে সরকারি চাকুরিতে মাত্র ১ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন কাজ করছেন। এই হচ্ছে পার্থক্য। এই হলো ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক ভারত, এই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতার দেশ ভারত।”

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের এক বক্তব্যের সমালোচনা করে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, “১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, বর্তমান বাংলাদেশের জন্য নয়। ভারতের কাছে নতজানু হওয়ার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করি নাই, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। বতর্মান সরকারের নতজানু নীতির প্রতিবাদ করছি।

“‘গুন্ডা’ সিনোমা বানিয়ে ভারতের গণমাধ্যম জানিয়েছিল- তারা নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনাব পারিকার বলেছেন, তারা নাকি স্বাধীনতা পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন। আপনারা সবাই একযোগে বলুন, শেইম শেইম শেইম। ভারত আমাদের সহযোগী ছিল, আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।”  

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মূর্তজা, ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য আজাদ মাহবুবু, কেন্দ্রীয় নেতা প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর, সাইদুর রহমান তামান্না প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

‘গণতন্ত্রের লেবাসে মানবতা ভুলুণ্ঠিত’ 

সরকার গণতন্ত্রের লেবাস পরে ‘মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত’ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিকালে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “সারা বিশ্বে মানবতা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে এই অঞ্চলে। আজকে গণতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের লেবাস পরে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদের এখানে মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই, কথা বলার স্বাধীনতা নেই, মুক্ত চিন্তা বলে কিছু নেই। এখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, এখানে মানুষের সংগঠিত হওয়ার কোনো রকমের কোনো সুযোগ নেই।

“আজকেও তো আমাদের পার্টি অফিসের সামনে থেকে একজনকে ধরে নিয়ে গেল। তারা (সরকার) যা করছে তা-ই করছে।”

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশে একটি ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ডিআরইউয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট: রাষ্ট্র নাকি মানবতা’ শিরোনামের ওই আলোচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি নেতা ফখরুল।

“আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মিয়ানমারের এই দুঃস্থ অসহায় মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে হবে। একইসঙ্গে তাদের স্বসন্মানে যাতে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে যায়, তার জন্য কূটনীতিক সফল ব্যবস্থা নিতে হবে, বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে কারণ আমরা এর ভুক্তভোগী।”

১৯৯৩ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে  রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ওই সময়ে একইভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপরে নির্যাতনের ফলে হাজার হাজার সম্ভবত ৩০ হাজার, পরবর্তীকালে সেটা এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে।

“সেদিন দেশনেত্রী তাদের নৌকা ফেরত দেননি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেননি। তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের জন্য সাময়িক ছাউনি করে দিয়েছেন, তাদের খাবার সরবরাহ করেছেন। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সীমান্তে মোতায়েন করেছিলেন।”

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারের নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্য আমাদের, আজকে যারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছেন, তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল, নিজেদের কিছু করার শক্তি নেই, সেই মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশের সুনাম ছিল মানবতা দিয়ে। একাত্তর সালে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়েছিল আমাদের ওপর পাকিস্তানি হানাদারের নির্যাতনের ফলে।

“এই সরকার কোনোভাবে কোমর সোজা করে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের যে চেহারা সেই চেহারা নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। পারছে না এজন্য যে, তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। জনগণের ওপরে তাদের ভিত্তি নেই। মানুষের ‘পালস’ তারা বোঝে না। জনগণ কী চায়, তাদের ভাষা উপলব্ধি করতে পারে না। তারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।” 

সংগঠনের প্রধান ব্যারিস্টার মীর মো. হেলালউদ্দিনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বক্তব্য রাখেন।