ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুক্রবার বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের একাদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ‘কমরেডদের’ উদ্দেশে এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “আমি আহ্বান জানাই- সমস্ত বামপন্থি ও কমিউনিস্টরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে বাম ঐক্য গড়ে তুলুন, সঙ্গে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে শামিল করে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তুলুন।”
বহুবার ভাঙন পেরিয়ে আসা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দেন সেলিম।
বাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণফোরাম, ন্যাপ, জাসদ (আম্বিয়া), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ঐক্য ন্যাপ, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, কমিউনিস্ট কেন্দ্রসহ কংগ্রেসে আসা বাম দলগুলোর জ্যেষ্ঠ নেতাদের সামনে রেখে তিনি বলেন, “দলকে মজবুত করতে হবে। … আমি অন্যান্য সকল কমিউনিস্টদের কাছে আকুল আবেদন জানাতে চাই, আসুন আমরা একত্রিত হয়ে যাই, সমস্ত কমিউনিস্ট এক হয়ে যাই।”
“বামপন্থিরা একত্রিত হয়ে অন্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আজকে লড়াই গড়ে তুলুন। আওয়ামী লীগ ব্যর্থ, বিএনপি আরও বেশি ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে আপনারা বাংলাদেশকে মুক্ত করে দিন।
“দেশে লুটতরাজের রাজত্ব আগের মতেই বহাল আছে, শোষণ-বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ তার ভোটদানের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু হারিয়েছে।… সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে জাতীয় পার্টি।”
সেলিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির কোনো স্থান বাংলাদেশে থাকতে পারে না। সুতরাং এমন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ করতে হবে, যেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দল- উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হবে।
“দেশের মানুষ বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতারণা ও অপশাসনে আজ অতিষ্ঠ। তারা এই যাঁতাকল থেকে মুক্ত হতে চায়। এই অসহনীয় পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বামপন্থিদের। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচাতে এই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।”
সরকারের সমালোচনায় এই বাম নেতা বলেন, “সরকার বলে দেশে নাকি উন্নয়নের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, আর সেই উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রকে আপাতত বাক্সবন্দি করে রাখতে হবে।”
কোনো অজুহাতেই সিপিবি গণতন্ত্রকে বাতিল বা সীমিত করার ষড়যন্ত্র ‘মেনে নেবে না’ মন্তব্য করে আবু জাফর বলেন, “গণতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ। আর উন্নয়নের নামে যে গল্প শোনানো হচ্ছে সেটাও সঠিক নয়। উন্নয়ন হয়েছে কিছু লোকের, লুটেরা ধনিক শ্রেণির, আর সরকারদলীয় লুটপাটকারীদের।”
সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমালোচনা করে বাম ঐক্য গড়ার তাগিদ দেন।
কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো অসুস্থতার জন্য অনুষ্ঠানে না আসায় তার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান প্রেসিডিয়ামের আরেক নেতা লক্ষ্মী চক্রবর্তী।
সমাজতন্ত্র যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ, তা আজকের ‘লুটেরা পুঁজিবাদীরা’ ভুলিয়ে দিতে চায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ওই শ্রেণি এখন গেড়ে বসেছে; তার সঙ্গে রয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন’।
“আমাদের নিকট অতীত ও বর্তমানের শাসকরা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশি লুটেরা শ্রেণির হাতে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রও ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণিসহ শ্রমজীবী মানুষ।”
‘সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা নিপাত যাক’ স্লোগানে সিপিবির একাদশ কংগ্রেসে মিলিত হয়েছেন সারাদেশ থেকে আসা ৬৮৩ জন প্রতিনিধি।
ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়াসহ ১২টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ২৬ জন প্রতিনিধি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিদেশি প্রতিনিধিদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতারা।
কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যেসব দেশ থেকে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলো বার্তা পাঠিয়েছে সেসব পার্টির নামও ঘোষণা করা হয়।
এরপর দলটির সভাপতিমণ্ডলির সদস্যরা বিদেশি প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলন মঞ্চের পাশেই নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। উদ্বোধনের আগে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গীতিআলেখ্য ‘দিন বদলের পালা’ পরিবেশন করে।
সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও জসিমউদ্দিন মণ্ডল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য বিমল বিশ্বাস ও কামরুল আহসান, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের বিপ্লবি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদ সাইফুল হক, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল ইসলাম কামাল, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খান, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আব্দুস সাত্তার ও আজিজুর রহমান, জাসদের (নুরুল আম্বিয়া) স্থায়ী কমিটির সদস্য মোস্তাক হোসেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সদস্য রমিজ উদ্দিন, সংযুক্তি ইউনিয়নের সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন নাসু, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, শ্রমিক জোটের সভাপতি আব্দুল কাদের হাওলাদার, সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের হারুন-উর রশিদ, বাসদের সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতিমণ্ডলির সদস্য মাহমুদুর রহমান বাবু উপস্থিত ছিলেন সিপিবির কংগ্রেসে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদও এসেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
এর আগে সিপিবির দশম কংগ্রেস হয়েছিল ২০১২ সালের ১১-১৩ অক্টোবর। চার বছর পর এবারের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কংগ্রেস উপলক্ষে শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের (২য় তলা) কনফারেন্স কক্ষে ‘সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উদারনীতিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে কংগ্রেসে যোগদানকারী বিদেশি প্রতিনিধিরা আলোচনা করবেন।
এর পাশাপাশি ২৯ ও ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মহানগর নাট্যমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে।
বৃষ্টিতে ভিজে একাকার
কংগ্রেসে যোগ দিতে শুক্রবার দুপুরের আগে থেকেই হাতে লাল পতাকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থলে জড়ো হতে শুরু করেন।
তাদের অনেকের গায়ে ছিল লাল টি-শার্ট; মাথায় লাল রঙের ক্যাপ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন মঞ্চও তৈরি করা হয়েছে লাল কাপড়ে ঘিরে।
বিকাল ৩টা ২০ মিনেটে কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর পর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে শুরু হয় বৃষ্টি। এতে বিপাকে পড়েন হাজারো নেতাকর্মীসহ মঞ্চে থাকা অতিথিরা।
মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ সিপিবির চারজন নেতা বৃষ্টিতে ভিজেই বক্তব্য দেন। মূল মঞ্চের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের বসার স্থানে বৃষ্টি ঠেকানোর ব্যবস্থা না থাকায় ভিজে যান সবাই।
বৃষ্টি শুরুর পর অনেককেই এদিক-ওদিক ছুটতে দেখা যায়। অল্প সময়ের বৃষ্টিতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেশ কয়েক স্থানে পানি জমে যায়।
সম্মেলন স্থল থেকে বের হওয়ার সময় একজনকে বলতে শোনা যায়, “উন্নয়নের নমুনা, বৃষ্টি এলেই যমুনা।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ দিকে সিপিবি সভাপতি সেলিমের বক্তব্য শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর বৃষ্টি থামে।
পরে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীত পরিবেশন করে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শাহবাগ-টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত শোভাযাত্রা হয়।