অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সেরা দৃষ্টান্ত চীন: রুশ কমিউনিস্ট নেতা

চীন অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সফররত রুশ কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2016, 02:47 PM
Updated : 29 Oct 2016, 02:58 AM

কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ান ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলেক্সান্ডার পোতাপভ শুক্রবার ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছেন তিনি।

বর্তমান চীন সম্পর্কে জানতে চাইলে পোতাপভ বলেন, বিজ্ঞান, শিল্পসহ অনেক অনেক ক্ষেত্রে তাদের অনেক অর্জন রয়েছে।

“কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না সম্ভবত বিজ্ঞোচিতভাবেই তাদের দেশকে শাসন করছে। আমরা দেখি, পাবলিক কন্সট্রাকশনে তারা খারাপ দৃষ্টান্ত নয়। অর্থনীতি ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয়ে তারা সেরা দৃষ্টান্ত।

“চায়না থেকে নেওয়া অনেক ইতিবাচক বিষয় আমরা আমাদের নোটবুকে নেই। কিন্তু একেকটা দেশের এগিয়ে যাওয়ার চিত্র একেক রকম, এটা ১৯৯১’র পূর্বেও হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেও ছিল।”

১৯১৭ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া বিপ্লবের মাধ্যমে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করে সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে চীনেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলেও ষাটের দশকে এসে নানা বিষয়ে মতভিন্নতা থেকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়।

ওই সময় বিভিন্ন দেশেও কমিউনিস্ট আন্দোলন চীনপন্থি, সোভিয়েতপন্থি হিসাবে পরিচিতি পায়। ১৯৭৬ সালে মাও’র মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে চীনে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। একের পর এক সংস্কার চালিয়ে, উদার নীতি গ্রহণ করে চীন বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকে এসে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরসূরি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ান ফেডারেশন। রাশিয়ান সংসদের নিম্নকক্ষের ৪৫০ আসনের মধ্যে ৯২টি এই দলের।

চীনের এই সফলতা থেকে নিজেদের শেখার এবং তা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক পোতাপভ।

“আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কারও সফলতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে সে সবের মাধ্যমে নিজেদের দেশের কৌশল ঠিক করা,” বলেন তিনি।

কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ান ফেডারেশনের মস্কো অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন পোতাপভ।

সোভিয়েত উত্তর রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সোভিয়েত উত্তর রাশিয়ার রাজনীতি ছিল বেশ কিছু বুর্জোয়া পার্টিকে নিয়ে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপরপ্রান্তে একটা সংসদীয় দলই ছিল, সেটা হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ান ফেডারেশন। 

“সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাজনৈতিক মানচিত্রে ১৯৯৩ সালের প্রথম নির্বাচন থেকেই আমাদের দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু করে। সমাজের সমর্থনহীনভাবে কেবল কিছু আদর্শের কাজ করে যাওয়া দল আমরা নই। শিল্প ও ‍কৃষি খাতের শ্রমিক-মজুর, প্রকৌশলী, চাকুরিজীবী, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র-সবখানেই আমাদের সমর্থন রয়েছে।”

“রাশিয়াজুড়ে আমাদের বিভিন্ন ডিভিশন রয়েছে। এ রকম ৯০টি ডিভিশন রয়েছে, যেগুলোতে স্থানীয় সরকার ও সংসদ রয়েছে। রাশিয়া ফেডারেশন এত বড় যে, অনেকে বলে এটাকে শাসন করা কঠিন। এটা সম্ভবত আংশিক সত্যও। একটা ফেডারেল পার্টি চালানোও সহজ না। কিন্তু আমরা সেটা করছি।”

এখনও লাখ লাখ রাশিয়ানের সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা রয়েছে বলে মন্তব‌্য করেন পোতাপভ।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ‌্য দিয়ে যেতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “১৯৯৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সংসদে গুলিও চালিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম এবং এখনও বেঁচে আছি।”

এক সময় বিশ্বজুড়ে তরুণদের প্রাণে দোলা দেওয়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এখন আর আগের মত এই বয়সীদের টানতে না পারার পরিস্থিতি রাশিয়াতেও রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, এটা সত্য নয়। কিন্তু যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়, আমাদের দেশে পুঁজিবাদ চলে আসে। এটা ঘটে পশ্চিমাদের প্রভাব ও টাকায়। আমরা যেটাকে ব্ল‌্যাক নাইনটি বলি, তারপর তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য আদালতও খুলেছিল, কিন্তু সেটা সফল হয়নি।

“কমিউনিস্ট পার্টি কোনোভাবে দোষী- এটা কেউ বলতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অর্থায়নে পরিচালিত সোভিয়েতবিরোধী প্রচারণার ফলে সমাজের নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য আমাদের কিছুটা সময় নিতে হয়।”

ভবিষ্যতে রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখেন কি না, সেটা কোন পদ্ধতিতে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভোটারদের ইচ্ছার ভিত্তিতে আমরা এখনও ক্ষমতার জন্য লড়াই করছি।

“আমরা অবশ্যই নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করছি। কিন্তু রাশিয়ায় স্থানীয়ভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণার ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নতুন প্রজন্মের অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে জানে না, মহান অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে জানে না, ইমোশনালি তরুণদের অনেকে দলে আসছে।”

ভ্লাদিমির পুতিন নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি কয়েক বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায়। দলটি নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনার সুর পাওয়া গেলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পোতাপভের কথায়ও। 

তিনি বলেন, “ক্ষমতাসীন দল প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের ওপর ভিত্তি করে আছে। কাউকে যদি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা হতে ডাকা হয়, সে দলের সদস্য হতে পারে। অবসরে গেলে সে চলে যায়, বাই বাই....। সুতরাং এটা সত্যিকারের রাজনৈতিক দল নয়। এটা একটা প্রশাসনিক দল।”

সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ আমাদের দলে আসে তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়। কিন্তু কখনও কখনও তারা ইমোশন থেকেও আসেন। তখন আমরা তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান চর্চার সুযোগ দিই, বই দিই, মার্কসবাদ ও লেনিনের কাজ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেই। তারা জ্ঞান লাভ করে, রাষ্ট্র সম্পর্কে বড় চিন্তার মাধ্যমে নিজেদের শুদ্ধ করতে পারে, শ্রমিক শ্রেণির অধিকার এবং কীভাবে অবস্থার উন্নতি করা যায়- সে সম্পর্কে তারা জানতে পারে।”

অর্থনৈতিক মন্দার সময় রাশিয়ায় অনেক তরুণ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে বলে জানান তিনি।

রুশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আগামী বছর বড় আয়োজনের পরিকল্পনার কথা জানান পোতাপভ।

“এটা কেবল রাশিয়ার স্থানীয় একটি ইভেন্ট হবে না, এটা সম্ভবত আন্তর্জাতিক ইভেন্ট হবে। কারণ অক্টোবরের মহান বিপ্লব সামাজিক ন্যায়বিচার ও জাতীয় স্বাধীনতার জন্য পথ দেখিয়েছে।”

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে আত্মপ্রকাশকারী প্রাভদার বড় ভূমিকা ছিল এই আন্দোলন বিকাশে।  

মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ‘বিলম্বে’ হলেও এক সময় সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন আলেক্সান্ডার পোতাপভ। 

তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিনই আমাদের কাজ করছি। আমাদের জনগণকে সবচেয়ে ভালো জীবন, আবাসন দিতে, সবচেয়ে ভালো রেগুলেশনে চালানোর জন্য নেতৃত্ব দিতে আমাদের যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ইভেন্টের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্ষমতায় যেতে আমাদের জনগণের দেওয়া যে কোনো সম্ভব পথ আমরা গ্রহণ করব।”

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যখন কোনো বন্ধু এগিয়ে আসে এবং এই ক্ষেত্রে জ্বালানি সুযোগ বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়, পরে অন্য যে কোনো সুযোগ বাড়াতে এগিয়ে আসে, সেটা ভালো।

“বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি আমাদের যোগাযোগ বাড়াবে এবং ক্ষেত্র বিস্তৃত করবে। এক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি খুবই আগ্রহী। কারণ এটা সম্পর্ককে ভালো ও বিস্তৃত করার সেতু। আপনি কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, এটা তাদেরকেও আগ্রহী করবে। কিন্তু আমি তাদের সত্যিকারের অবস্থান জানি না।”

এ সংক্রান্ত অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ওই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে বলে আমি শুনিনি।

“কিন্তু কয়েক বছর আগে সিপিবির কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে কোনো ধরনের সহযোগিতায় আগ্রহী। আর সেটা নানা কারণে- বাংলাদেশের উন্নতির জন্য, আমাদের অতীত ভালো সম্পর্কের জন্য।”