৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে আ. লীগ: খালেদা

আওয়ামী লীগ সরকার গত ৭ বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2016, 01:20 PM
Updated : 1 May 2016, 04:22 PM

তিনি বলেছেন, “আজ উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রকল্প তৈরি করে তারা ভাগ-ভাটোয়ারা করছে। বিদেশে টাকা পাচার করছে। আওয়ামী লীগ সাত বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।”

মে দিবস উপলক্ষে রোববার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক শ্রমিক সমাবেশে এ কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মানুষ কতো কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। সে টাকা যদি আওয়ামী লীগ চুরি করে নেয়, তাহলে কী মানুষের কষ্ট বাড়বে না কমবে?”

সরকারের সমালোচনায় খালেদা বলেন, “কথায় কথায় উন্নয়ন বলে। কী উন্নয়ন তারা করেছে? যতো উন্নয়ন করেছে তার বেশি তারা চুরি করেছে।”

পানামা পেপারসে যাতে ‘নাম না আসে’, সেজন্য ক্ষমতাসীনরা এখন ‘ধরাধরি’ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গত ১৯ মার্চ  কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে দল গোছানোর প্রক্রিয়া শুরুর পর এটাই ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রথম জনসভা।

৫১ মিনিটের বক্তব্যে তিনি দেশের পরিস্থিতি, শ্রমিকদের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন এবং সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ‘নির্যাতন-নিপীড়ন’, সরকারের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি-অপশাসন’, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের অ্যাকাউন্টে ‘সন্দেহজনক উৎসের অর্থ’ থাকার অভিযোগ তোলেন।

উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “আপনারা প্রতিদিন শুনছেন, বিএনপি নাই, বিএনপি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা এটা বলে যাচ্ছে। আজকে এই শ্রমিক সমাবেশে এই গরমের মধ্যে সমাবেশ প্রমাণ করে, বিএনপি রাজপথেই আছে, মানুষের সঙ্গে আছে; শ্রমিক, কৃষক, যুবা, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেই আছে।”

এরপর ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আপনারা জনগণকে ভয় পান বলে কাচের ঘরে, এয়ারকন্ডিশনড ঘরে বসে শ্রমিক দিবস পালন করছেন। আপনারা কাচের ঘরে বসেই সব কিছু করবেন।”

জয়কে ‘জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার’

সমাবেশ মঞ্চে টাঙানো শফিক রেহমানের মুক্তির দাবিতে পোস্টারের দিকে ইংগিত করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “শফিক রেহমান কোনো রাজনীতি করেন না। তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? তার দোষটা কী ছিল? দোষটা ছিল- প্রধানমন্ত্রীর পুত্র... কী যেন নাম?”

নেতা-কর্মীরা এ সময় ‘চোর চোর’, ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে আওয়াজ দিতে থাকেন।

খালেদা বলেন, “আদালত তার (সজীব ওয়াজেদ জয়) অ্যাকাউন্টে তিনশ মিলিয়ন ডলার, আড়াই হাজার কোটি টাকা নিয়ে সন্দেহ করেছে। এফবিআই এই টাকা তদন্ত করে পেয়েছে। এখানে শফিক রেহমানের দোষটা কোথায়? তাকে গ্রেপ্তার করে এখন নাটক চলছে।”

অবিলম্বে শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, শওকত মাহমুদসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি করেন খালেদা জিয়া।

সরকারপ্রধানের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনি তাদেরকে যদি মুক্তি না দেন, আপনি যদি সত্যি সত্যি দেশের মানুষের প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন, তাহলে এই যে তিনশ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ আড়াই হাজার কোটি টাকা আপনার ছেলে জয় কোথা থেকে পেল, তাকে ভেতরে নিয়ে জিজ্ঞাসাদ করা দরকার। ওই অর্থগুলো কী বৈধ? এটাকে চাপা দেওয়া যাবে না।”

‘হাসিনা যেমন, ইসিও তেমন’

খালেদা জিয়া বলেন, “আজ শ্রমিকরা কেউ ভালো নেই। রানা প্লাজার শ্রমিকরা এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পায় নাই।... অথচ জবরদখলকারী এই ক্ষমতাসীনরা সর্বত্র লুটপাট করছে। তারা দেশের মানুষকে মানুষ মনে করে না। তারা দেশটাকে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে।”

বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে পোশাক শিল্পসহ শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতায় বসেছে। তারা নির্বাচিত নয়। সেজন্য তারা অবাধে লুটপাট করছে। যখন তখন নতুন আইন তৈরি করছে, যাতে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারে।”

বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনার সরকার সকল দল ‘বন্ধ করে’ দিয়ে ‘একদলীয় শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ‘এ কারণেই’ তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়।

স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর উদাহরণ টেনে খালেদা বলেন, বর্তমান ‘আজ্ঞাবহ, অর্থব, মেরুদণ্ডহীন’ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই ‘সম্ভব নয়’।

“আমি বলতে চাই, হাসিনা যে রকম, নির্বাচন কমিশনও সে রকম। আজকে আমি বলতে চাই, তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”  

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া

দেশে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, “আপনি বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পেরে নাকি গুপ্তহত্যা করছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পথ কোথায়? নির্বাচন কী হয়েছে দেশে? বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যেতে চায় না। চোরাপথে ক্ষমতায় যেতে চায় না।

“সেজন্য বলছি, ক্ষমতা ছেড়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করুন। দেখা যাবে জনগণ কাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়... তা প্রমাণ হবে।”

বিএনপিনেত্রী বলেন, তাদের দাবি ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’, কেননা ‘গণতন্ত্র না থাকলে’ মানবাধিকার থাকবে না, উন্নয়ন হবে না, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে না, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না।

“এখন পর্যন্ত এতো লোক মারা গেল, তাদের বিচার হয়েছে? কারণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে তাদের ধরা হয়নি। সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়েছে? হয়নি। আপনারা জানেন, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের বিচার হয়েছে কী? এখন পর্যন্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ থাকাকালে কোনো বিচার হবে না।”

গুম হলে দায় ‘জিয়ার’

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসানকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালক করার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন খালেদা জিয়া।

“আপনারা সবাই নামটা শুনেছেন, আমিও শুনেছি। র‌্যাবের একজন। এই কর্নেল জিয়া, র‌্যাবের ডিডিজি ছিল। তার সময়ে অনেক গুম-খুন হয়েছে। তাকে হঠাৎ করে প্রমোশন দিয়ে ব্রিগেডিয়ার করা হয়েছে।

“মূল উদ্দেশ্য আরও খুন-গুম করানো। সেজন্য পদোন্নতি দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। আমি বলতে চাই, এরপর যদি গুম-খুন হয়, এর জন্য জিয়া দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।”    

খালেদা জিয়া বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সময়ে গুম-খুনের জন্য প্রধানমন্ত্রীও রেহাই পাবেন না, আল্লাহ তায়লা বিচার করবেন।”

বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ‘জিয়া পরিবারকে ধ্বংস’ করার চক্রান্ত হয়েছিল অভিযোগ করে খালেদা বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা দিয়েছিল। জিয়া পরিবারকে তারা ধ্বংস করতে চেয়েছে। আমার মা নেই, বাবা নেই, বোন নেই, ছোট ছেলে নেই। আজ আমরা একমাত্র ভরসা আপনরা, এদেশের জনগণ, শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষ।”

উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আসুন, দেশ রক্ষা করতে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। আমরা সকলের কাছে বলব, আসুন আমরা সকলে এক হই। শ্রমিক দিবসে এটাই হোক আমাদের শপথ।”

সমাবেশের সোহরাওয়ার্দী

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের উদ্যোগে এই সমাবেশে ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, টঙ্গী ও সাভার থেকে আসা বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও বিএনপি নেতাকর্মীরা অংশ নেন। ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন তারা।

শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে বেলা দেড়টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। খালেদা জিয়া পৌঁছালে নেতাকর্মীরা করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। হাত নেড়ে তাদের অভিনন্দনের জবাব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

সমাবেশ উপলক্ষে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানার ও ফেস্টুনে সাজানো হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকা। সভামঞ্চের সামনেই বড় হরফে লেখা দেখা যায়- ‘আমি একজন শ্রমিক এবং এ পরিচয়ে আমি গর্বিত’।

এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা এড়াতে উদ্যান এলাকায় মোতায়েন করা হয় বাড়তি পুলিশ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিউশন মিলনায়তনে পুলিশের জলকামাল, প্রিজন ভ্যানও প্রস্তুত দেখা যায়।

এর মধ্যেও খালেদা জিয়া পৌঁছানোর ঘণ্টাখঅনেক আগে মঞ্চের পশ্চিম দিকে সামনের অংশে বসা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে পানির বোতল ছোড়াছুড়ি হয়। পরে নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

শ্রমিক সমাবেশ উপলক্ষে বিএনপির চিকিৎসক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (ড্যাব) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ ছাত্রদল শাখা উদ্যানের এক পাশে দুটি মেডিকেল ক্যাম্প খোলে। সেখান থেকে নেতা-কর্মীদের পানি সরবারহ করা হয়।