জঙ্গি দমনে ‘সহযোগিতা’ করতে চায় বিএনপি

বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ড দমনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ‘সবচেয়ে অভিজ্ঞ’ ও ‘সফল’ দাবি করে বিএনপি বলেছে, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2016, 10:33 AM
Updated : 29 April 2016, 05:06 PM

সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান হত্যাসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি খুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে দলের এই অবস্থান তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

“বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সফল সরকার বিএনপি। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, মানবতা, সভ্যতাবিরোধী যেকোনো ধ্বংসাত্মক জঙ্গি কর্মকাণ্ড দমন করতে অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিএনপি সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

“বিএনপি দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে শান্তি, স্বস্তি, মানুষ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রবিরোধী প্রাণবিনাশী জঙ্গি শক্তিকে দমন করতে সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সরকার জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলেও অভিযোগ করেন এই বিএনপি নেতা।

তবে ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশসহ (জেএমজেবি) বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে, তারা সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা চালায়।

দেশের উত্তরাঞ্চলে জঙ্গি নেতা নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও ছিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের সম্পর্কের কথাও গণমাধ্যমে এসেছে।

এই দুই দলের উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতার বিরুদ্ধে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ উঠে, যাদের অনেকেই পরে দণ্ডিত হন। জেএমজেবির নেতা শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে বিএনপির একাংশ ও জামায়াতের সম্পর্কের বিষয়টিও গোপনীয় নয়।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী অভিযোগ করেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের না খুঁজে বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাসহ অনেক কর্মীকে জড়িয়ে আসল অপরাধীদের আড়াল করা হয়।

“পরবর্তীতে পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওইসব জঙ্গি বোমা হামলার ঘটনার সঙ্গে হরকাতুল জিহাদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন জড়িত ছিল, যার জন্ম ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর।

“সেই সংগঠনের প্রধান মুফতি হান্নানকে গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্প এলাকায় একটি কেমিকেল কারখানা স্থাপনের জন্য জমি প্রদান করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, যা সর্বজনবিদিত। সেই কারখানাতে মুফতি হান্নান বোমা তৈরি করতো। তাকে (মুফতি হান্নান) গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করেছিল বিএনপি সরকার।”

২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায় করা মামলার আসামি মুফতি হান্নান কারাগারে রয়েছেন। শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিতে হত্যার পেছনের মূল ব্যক্তি বলা হয় তাকে।

রমনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে এবং সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার মামলায় এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন তিনি।

বর্তমান সরকারের আমলে দুই বিদেশি নাগরিক এবং ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যার ঘটনায় বিএনপিকে দোষারোপ করায় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের সমালোচনা করেন রিজভী।

“সরকার ‘মূল জঙ্গিদের’ আড়াল করার জন্যেই বিএনপি নেতাদের ওপর বার বার এসব জঙ্গি হামলার দায় চাপিয়ে যাচ্ছে। অথচ আলোচিত এসব ঘটনার এখনো পর্যন্ত ক্লু বের করতে পারেনি সরকার।”

বিএনপি ‘হত্যা-সন্ত্রাস-খুনের রাজনীতি’ করে না দাবি করে তিনি বলেন, “বরং আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রীর আত্মীয়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জেএমবিকে বিএনপি আমলেই নির্মূল করা হয়েছিল।

“বিএনপির জঙ্গিবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণেই সেই সংগঠনের শীর্ষ নেতা ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতার আত্মীয় শায়খ আবদুর রহমানসহ সকল জঙ্গিকে ধরে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে দেশে জঙ্গিবাদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হয়েছিলো।”

রিজভী বলেন, “বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি আমলে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা বিভিন্নভাবে জেল থেকে পালিয়ে যায়, এতে কারা সহযোগিতা করেছে, কারা জামিনে মুক্ত করে দিয়েছে তা জনগণের অগোচরে নেই। বিএনপি আমলে হরকাতুল জিহাদ ও জেএমবির জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৫৬টি মামলার কার্য্ক্রম স্থগিত করে দিয়েছে সরকার।”

 ২০১৪ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এই বিএনপি নেতা বলেন, “ওই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলো ফারুক ও জাকারিয়া নামে দুই জঙ্গি। তারা দুজনই বিগত বিএনপি সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়েছিল। আর তারা কারাগার থেকে মুক্তি পায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে। ফারুক বর্তমানে জেএমবির আমির।”

রিজভী বলেন, “আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান বন্ধ করুন। প্রকৃত জঙ্গিদের খুঁজে বের করুন। তাদের বিচারের আওতায় বিচারের আওতায় আনুন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন।”

জঙ্গিরা বর্তমান সরকারের দ্বারা প্রশ্রয় লাভ করছে বলে মন্ত্রী ও নেতাদের কথাবার্তাতেই স্পষ্ঠ হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কয়েকদিন পূর্বে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, লাদেনের প্রশিক্ষিত ৮ হাজার জঙ্গি বাংলাদেশে এসেছে। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে তা অস্বীকার করেছেন।

“প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বক্তব্য হল- বিএনপিকে দোষারোপ না করে হাসানুল হক ইনু সাহেবের নিকটে জানতে চান যে জঙ্গিরা কোথায় আছে? কারণ, ইনুই জানেন জঙ্গিদের হদিস কোথায় আছে? জঙ্গি হামলার পর আপনাদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া জঙ্গি আততায়ীদের আড়াল করতে বিএনপিকে জড়িয়ে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারণ জনগণ তা বিশ্বাস করে না।”

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে থেকে কীভাবে জঙ্গি দমনে সহযোগিতা করবেন জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, “আমরা বিএনপির অবস্থানের কথা আমরা বলেছি। এটা বিএনপির সংবাদ সম্মেলন। আমরা সরকারের ছিলাম। জঙ্গিদের কীভাবে ধরা হয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, তাদেরকে শাস্তির বিধান করা হয়েছে- সেগুলো তথ্য উপাত্ত সহকারে বস্তুগত বিশ্লেষণ আমরা তুলে ধরেছি।

“আওয়ামী লীগের আমল থেকেই জঙ্গি আক্রমণ শুরু হয়েছে। তারা শুধু অপরকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু প্রকৃত জঙ্গিরা কোথায় আস্তানা গাড়ছে, এই চক্রটি কিভাবে বৃদ্ধি লাভ করছে, তারা একের পর এক ঘটনা কীভাবে ঘটিয়ে চলছে- এটিকে চিহ্নিত করে এদেরকে ধরে আইনের আওতায় আনার কোনো দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি।

“বরং বিএনপির নামে মিথ্যা কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এটা জনগণের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই সরকারই এগুলোকে মদদ দিচ্ছে।”

সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।