বৃহস্পতিবার সকালে কাজী জাফরের মৃত্যুর পর এভাবে স্বামীর চিরবিদায়ের মুহূর্তের বর্ণনা দেন তার স্ত্রী মমতাজ বেগম।
৭৬ বছর কাজী জাফর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসা জানিয়েছেন, স্বামীর সাড়া না পেয়ে ওই হাসপাতালেই তাকে যান মমতাজ।
হাসপাতালে বসে বিলাপ করতে করতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কথা ছিল বুলু (কাজী জাফর) তার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাবেন। কিন্তু সেখানে না গিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।”
তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে ৭টায় ট্রেন। সব প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। গৃহকর্মী তার পোশাক ইস্ত্রি করছিল। আজকে সকাল সকাল নাস্তা করেছে বুলু। এরপর সে বলল, আমার একটু কোমরের কাছে ব্যথা করছে। তাকে বিছানায় বিশ্রাম নিতে বলি। সে তা-ই করল।
“হঠাৎ দেখি, সে কোনো কথা বলছে না। চোখ বন্ধ। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তাকে বললাম কী হয়েছে, ওঠো, কুমিল্লা যাবে না? ট্রেন সাড়ে ৭টায়।
“না তার মুখে কোনো কথা নেই। ভাবলাম হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরে হাত দিয়ে বললাম এই ওঠো। না, সে না জানা দেশে চলে গেছে। দ্রুত আমার উপরের তলায় ক্যাপ্টেন রফিককে ঢেকে আনলাম।”
সর্বশেষ সকাল সাড়ে ৫টায় কাজী জাফর নাস্তা করেছিলেন বলে জানান তিনি।
প্রেমের সম্পর্ক থেকে জাফর-মমতাজের বিয়ে হয় বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন।
স্বামীর রাজনীতির প্রতি আকর্ষণের কথা তুলে ধরে মমতাজ বেগম বলেন, “বুলু অষ্টম শ্রেণি থেকে রাজনীতি শুরু করে। টঙ্গীতে রাজনীতি করেছে। পাকিস্তান আমলের কথা। জীবনের অনেক ঝুঁকি সেই সময়ে বুলু রাজনীতি করেছে। তারপরও কখনো পিছপা হয়নি।
“আমি সব সময় তাকে রাজনীতি করতে উৎসাহ দিয়েছি। বলতাম-তুমি জনগণের রাজনীতি কর, আমি সংসার দেখব। এ নিয়ে কোনো চিন্তা তোমার করতে হবে না। তুমি রাজনীতি নিয়ে দেশ সেবা কর। আমি তোমার পাশেই থাকব।”
স্বামীর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন বুলু। এক চুল পরিমাণ সে তার আদর্শকে বলি দেননি। সে সব সময় বলত-আমার আদর্শ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ। এই দেশকে এক রাখতে হবে। আমি তখন বলতাম- তোমার বয়স হয়ে গেছে- তুমি কি পারবে? সে বলত আমি অবশ্যই পারব। যদি তুমি আমার পাশে থাক।
“আমার স্বামীর টাকা-পয়সার কোনো লোভ ছিল না। শুধু রাজনীতি করতেন। একটা লোক বলতে পারবে না- সে অসৎ, চরিত্রহীন। তার কোনো ব্যবসা নেই। আমি তাতেই খূশি ছিলাম।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে ১৯৬২-১৯৬৩ সালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কাজী জাফর।
১৯৬৬ সালে তিনি চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন; পরে টঙ্গীর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচয় গড়ে ওঠে তার।
স্বাধীনতার পর তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং পরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৭৪ সালে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি) যোগ দেন কাজী জাফর।
এরপর তিন দশক এরশাদের আস্থাভাজন হিসেবে জাতীয় পার্টিতে থাকলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ নিয়ে মতবিরোধের জের ধরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন এরশাদ।
পরে দলের একাংশকে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামেই নতুন দল গঠন করে গতবছর ২৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন কাজী জাফর।
কয়েক বছর ধরেই হৃদযন্ত্র ও কিডনির সমস্যা ছাড়াও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন তিনি।
অসুস্থতার মধ্যেও তার রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে বলতে গিয়ে স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, “ইদানিং সে এরকম অসুস্থ শরীর নিয়েও রাজনীতির কর্মকাণ্ড করছিলেন। পুরনো বন্ধুদের খোঁজ নেওয়া, দলের নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর নেওয়া ইত্যাদি। ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলতেন। জোটের মিটিং ডেকেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই মিটিংয়েও তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। রাজনীতির জন্য অসুস্থতা তার যাত্রাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।”
সর্বশেষ গত ১২ আগস্ট গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন কাজী জাফর।
স্ত্রী ছাড়াও তিন মেয়ে রয়েছে কাজী জাফরের। তাদের মধ্যে দুই মেয়ে জয়া, সোনিয়া দেশে থাকেন। আর রুনা থাকেন অস্ট্রেলিয়ায় স্বামীর সঙ্গে।