রাষ্ট্র আর জাতীয় সমাজ: বাদশাহি আমলের ধর্মনীতি

১৯৭১ সাল বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র কায়েম করিয়াছে তাহার চারিসীমানা নির্ধারিত হইয়াছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ চুক্তিমাফিক।

. সলিমুল্লাহ খানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2013, 09:43 AM
Updated : 29 March 2013, 09:44 AM
১৯৭১ সাল বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র কায়েম করিয়াছে তাহার চারিসীমানা নির্ধারিত হইয়াছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ চুক্তিমাফিক। এই চুক্তির গোড়ায় ছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আর নিখিল ভারত মুসলিম লিগের মতৈক্য। আর ১৯৪৭ চুক্তির ভিত্তি ছিল ব্রিটিশশাসিত বাংলা (ও কিছু পরিমাণে আসাম) প্রদেশের মুসলমান ও অমুসলমান প্রজাসাধারণের সংখ্যামাফিক। কিছু কিছু জেলার ভাগাভাগি আর কয়েকটি স্থানের ভারতব্যাপী বিনিময়ের হিস্যাসহ মোটের উপর মুসলমানপ্রধান অঞ্চল লইয়া ১৯৪৭ সালে গঠিত পূর্ববাংলা প্রদেশই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হইয়াছে। সকলেই স্বীকার করিবেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান অমুসলমান বিভাজনটা বড় বিষয় হয় নাই। বড় বিষয় বরং হইয়াছিল মুসলমান আর অমুসলমানসহ বাংলাদেশের চারিসীমানার বাসিন্দা সর্বজনের ঐক্য বা মৈত্রী। এই ঐক্য গড়িতে স্বভাবতই জোর পড়িয়াছিল সকল জাতি ও শ্রেণীর সমানাধিকার দাবির উপর।

সম্প্রতি কোন কোন নতুন ব্যবসায়ী প্রচার করিতেছেন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা হইয়াছে। প্রশ্ন উঠিবে এই কাজটি কে করিয়াছে। প্রচারকেরা কর্তার একটা নামও খুঁজিয়া পাইয়াছেন: ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’। আর এই দুশমনের প্রতিপক্ষ আকারে তাহারা দাঁড় করাইতেছেন এসলামধর্মকে। আর কিছুদিন না যাইতেই হয়ত ইহারা আরো এক শত্রুর নাম লইবেন: বলিবেন ধর্মনিরপেক্ষতাই সমস্ত অনিষ্টের মূল। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর সংখ্যালঘু অমুসলমান জনসাধারণ অত্যাচার করিতেছেন কথাটা বিশ্বাস করিতে কষ্ট হয়।

যতদূর মনে পড়ে সকল জাতি আর ধর্মের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদি অঙ্গীকার। সকল ধর্মের সমানাধিকার যদি প্রতিষ্ঠা না পায় তো ‘গণতন্ত্র বলিতে বর্তমান জগতে সীমিত অর্থে যাহা বুঝায় তাহাও কায়েম হইতে পারিবে না। তাই আশংকা করি এসলাম উপেক্ষিত বলিয়া তৎপর ব্যবসায়ীরা যাহা কায়েম করিতে চাহিতেছেন তাহা হইবে একপ্রকারের স্বৈরতন্ত্র। এয়ুরোপের ইতিহাসে এই জাতীয় স্বৈরতন্ত্রের নাম দাঁড়াইয়াছিল ফ্যাসিবাদ।

বাংলাদেশ যে ধরণের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির অঙ্গীকার করিয়াছিল, অন্তত ১৯৭১ সালে, সৌভাগ্যের মধ্যে তাহার নজির বাংলাদেশের ইতিহাসেই আছে। মোগল বাদশাহ আকবর যে ধর্মনীতি পালন করিয়াছিলেন তাহাকে বাংলাদেশের অঙ্গ মনে করিলেই তো হয়। কথাটা কিন্তু নতুন নহে। ভারতবর্ষের ইতিহাস লইয়া যাহারা কিছু সময় অন্তত কাটাইয়াছেন তাহারাই সত্যটা জানেন। আমার কাজ কথাটা শুদ্ধ মনে করাইয়া দেওয়া। বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা নেতারাও সে সত্যের আংশিক স্বীকৃতি দিয়াছেন। চতুর লোকেরা হয়তো ইহাতে খুশি হইবেন না। তাহারা হয়তো বলিবেন আমি মোগল স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করিতেছি। বয়ান করিবেন বাদশাহ আকবর তো এসলামধর্ম ত্যাগ করিয়া অমুসলমান হইয়া গিয়াছিলেন। আমরা দেখিব এই অভিযোগ খানিকটা অতিশায়নের দোষে দুষ্ট।


একালের ইংরেজ ইতিহাস ব্যবসায়ী পার্সিবাল স্পিয়ার সাহেব মনে করেন বাদশাহ আকবর মনে মনে বরাবরই ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়ী’ বা লিবারেল ছিলেন। অনেকেই মনে করাইয়া দিয়াছেন হুমায়ুনের অকস্মাৎ অকালপ্রয়াণে আকবর বাদশাহ নামদার হইলেন ১৫৫৬ নাগাদ। ততদিনে তাঁহার বয়স টানিয়াটুনিয়া ১৪ বছর আর রাজ্যভার বা সত্যকার রাষ্ট্রক্ষমতাটা বাদশাহ নামদার হাতে লইলেন আরও চারি বছর পর। ক্ষমতা হাতে লইবার দুই বছরের মাথায়, মোতাবেক ১৫৬২ এসায়ি সালে, মহাত্মা আকবর হিন্দুজাতির পবিত্র তীর্থ মথুরা নগরের তীর্থকর মওকুফ করিয়া দিলেন। রাজার ব্যবসায় প্রজাসাধারণের যাহার যে ধর্ম সেই ধর্মপালনের স্বাধীনতা যতদূর পারা যায় অবারিত করা। আকবর বাদশাহ তাহাই করিলেন। ইহার পর তিনি অম্বরের হিন্দু রাজপুত পরিবারে বিবাহ করিলেন। রাজপুত জাতির সহিত মিত্রতার কারণে প্রশাসনের অনেক উচ্চপদ হিন্দু রাজাদের হাতে সঁপিয়া দিলেন। এক পর্যায়ে ‘জিজিয়া’ নামে হিন্দুজাতির মাথায় আরোপিত বিতর্কিত একটি করও তিনি রহিত করিলেন। এইসব ঘটনা অসত্য নহে। তবে আলিগড়ের মোগল ইতিহাসবিদ ইকতেদার আলম খান মনে করেন এহ বাহ্য।

১৫৭০ সালের দশকে বাদশাহ আকবর চমৎকার ধর্মচিন্তায় মাতিয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি ধর্মসভার আয়োজন করেন। সেখানে এয়াহুদি, নাসারা, জৈন, বৌদ্ধ আর পারস্যধর্মাবলম্বীদের (জরাথুস্ত্রপন্থী) পর্যন্ত দাওয়াত করা হইয়াছিল। এই ধর্মসভার যুগেই আকবরের আধাআধি ভাই কাবুলের শাসক মির্জা হাকিমের রাষ্ট্রবিদ্রোহ ঘটে। অনেক ভারতীয় আলেমওলামাও এই বিদ্রোহে যোগ দিয়াছিলেন। বলা যায় আকবরের ধর্মনীতিতে যাহারা অসন্তুষ্ট ছিলেন তাহারাই এই বিদ্রোহের হোতা ছিলেন। ১৫৮১ নাগাদ আকবর এই বিদ্রোহ নিবারণে সমর্থ হন। ইহার পর বড় আকারের বিদ্রোহ বড় আর হয় নাই। কিন্তু এই বিদ্রোহের অনুগামীরা আকবরের বিরুদ্ধে প্রচারণায় কোনদিনই ক্ষান্ত দেন নাই। আদতে তাহারাই নিরন্তর প্রচার করিয়াছেন বাদশাহ আকবর এসলাম ত্যাগ করিয়াছিলেন। আমরা বলিব কথাটি সামান্য অতিরঞ্জিত!

আকবরের এসলামধর্ম পরিত্যাগ নামক ঘটনা কল্পনা করিয়া এয়ুরোপ হইতে আগত খ্রিস্টান মিশনারি (খাস করিয়া বলিতে গোয়ার পর্তুগিস জেসুইট) পাদরিগণ পাইয়াছিলেন বিশেষ আনন্দ। খবরটা ইঁহারাই বিশেষ আমোদের সহিত এয়ুরোপ মহাদেশে প্রচার করিয়াছিলেন। তাঁহারা কখনও হয়তো বা আশা করিয়া থাকিবেন বাদশাহ আকবর বুঝি একটানে খ্রিস্টান হইয়া যাইতেছেন। তাঁহাদিগের সে আশা বলাবাহুল্য পূরণ হয় নাই। তাহাতে কি হইয়াছে! কল্পনাশক্তি উর্বরা পদার্থ। শুদ্ধ তাঁহারা নহেন, ইংরেজতনয় বিনসেন্ট স্মিথ প্রভৃতি ইতিহাসবেত্তা পুরুষও সদ্য বিগত এই বিশ শতকে আসিয়াও একটি না হয় আরেকটি মিছাকথা অবিরত প্রচার করিয়া গিয়াছেন। খ্রিস্টান না হইলে কি হইবে আকবর এসলামধর্ম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন! চালু করিয়াছিলেন নতুন একটি ধর্মমত! বিনসেন্ট স্মিথ এই সেদিনও জিব টানিয়া কথাটি বলিয়া গিয়াছেন।

এখানে সবিস্তার আলোচনার অবকাশ নাই। আপাতত বলিয়া রাখিতেছি, একালের ভারতীয় হিন্দু মুসলমান আর এয়ুরোপিয়া খ্রিস্টান সকল ইহিহাসবিদই একমত যে বাদশাহ আকবর এসলামধর্ম আদৌ ত্যাগ করেন নাই। তিনি এসলামের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করিয়াছিলেন মাত্র। গোঁড়া মুসলমান আলেমদের কেহ কেহ তাঁহাকে এ ব্যাপারে ভুল বুঝিয়াছিলেন। কেহ কেহ স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিহিংসার অধীন হইয়া তাঁহার উপর হামলা করিয়াছিলেন। আকবর আপনকার রাষ্ট্রকে একটা জাতীয় ভিত্তি দিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি চাহিয়াছিলেন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রকে জাতীয় সমাজের উপর দাঁড় করাইতে আর ভারতের নতুন জায়মান ‘জাতীয় সমাজ’কে হিন্দু আর মুসলমানের ঐক্যের উপর দাঁড় করাইতে। হিন্দু আর মুসলমানের ঐক্যমাত্র নহে, তিনি চাহিয়াছিলেন আরো। শিয়া আর সুন্নি এই দুই মুসলমান সমাজের ঐক্যবিধানও তাঁহার লক্ষ্যের অন্তর্গত ছিল। আকবর বাদশাহ সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দিয়াছিলেন। তাহার উপর তিনি শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতিও বজায় রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

আলিগড়ের ইতিহাসবেত্তা মহাত্মা আতার আলি এক জায়গায় দেখাইয়াছেন বাদশাহ আকবর যে হিসাবে সর্বোচ্চ সামরিক পদমর্যাদা (বা মনসব) বিতরণ করিয়াছিলেন তাহাতে এই বাসনার প্রকাশ পরিষ্কার। তিনি চাহিয়াছিলেন মোগল শাসকশ্রেণী যেন গঠনে সত্যসত্য ‘জাতীয়’ ঐক্যের প্রতিফলন ঘটায়। ১৫৯৫ নাগাদ জীবিত মনসবদারদের তালিকা ধরিয়া তিনি হিসাব করিয়াছেন (বাদশাহর পুত্র আর পৌত্রদের হিসাবের বাহিরে রাখিলে) আকবরের অধীন সর্বমোট ২৭৯ মনসবদারের মধ্যে হিন্দু মনসবদার ছিলেন ৪৭ জন। আর ৭৫ জন ছিলেন ইরানি অর্থাৎ শিয়া মুসলমান। মোট ৮ জন সর্বোচ্চ (৫,০০০ বা তদুর্ধ ) মনসবদারের মধ্যে হিন্দু ছিলেন মাত্র ১ জন আর শিয়া ৪ জন। মোট ১৩ জন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রেণীর (৩,০০০-৪,৫০০) মনসবদারদের মধ্যে হিন্দু ৩ জন আর শিয়াজাতির মুসলমান ছিলেন ৫ জন। মোট ৩৭ জন তৃতীয় শ্রেণীর (১,০০০-২,৫০০০) মনসবদারের মধ্যে ৬ জন হিন্দু আর ৬ জন ছিলেন শিয়াজাতির। চতুর্থ শ্রেণীর (৫০০-৯০০) ৬১ জনের মধ্যেও হিন্দু আর শিয়া ছিল সংখ্যায় সমান সমান, দুই গোষ্ঠীতেই ১২ জন করিয়া। সর্বশেষ শ্রেণীর (২০০-৪৫০) মোট ১৬০ জনের সারিতে দেখা যাইতেছে শিয়া ৪৮ আর হিন্দু ২৫।

আকবর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর এক সময় তাঁহার বাবার সরকার প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, উঁহার আমলে শিয়া-সুন্নি এক মসজিদে নমাজ পড়িত। একবার এক মোগল শাহজাদা (মির্জা ফৌলদ) শিয়া ধর্মবিশারদ মোল্লা আহমদ থাট্টাবিকে হত্যা করেন। প্রকাশ এই মোল্লা সাহেবটি খুব রাখঢাক না করিয়াই শিয়া ধর্মমতের পক্ষে প্রচারে মাতিতেন আর শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্য লইয়া নিত্য বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন। এই মামলার বিচারে মোগল শাহজাদার মৃত্যুদণ্ড হয়। অনেক তদবির সত্ত্বেও আকবর উঁহাকে ক্ষমা করেন নাই।
যাহাকে বলা হয় ‘ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা’ তাহার মধ্যে থাকিয়াও পাঠিকা দেখিবেন মোগল শাসকশ্রেণীর আধিপত্য যতদিন বজায় ছিল তাহার কঠিন গঠন এই বরাবর ছিল। আওরঙ্গজীবে আর আকবরের ধর্মাচরণে যত ভেদ থাকে তাহা শুদ্ধ আচরণ ধর্মেই। এই বিষয়ে শাসকশ্রেণীর গঠনধর্মে তাঁহাদিগের মধ্যে প্রভেদ বড় একটা দেখা যায় না।

আজ পর্যন্ত আকবর সম্বন্ধে এয়ুরোপিয়া নানান ভাষায় পুস্তকাদি যত লেখা হইয়াছে দেখা গিয়াছে তাহাদের সিংহভাগ জুড়িয়াই আছে তাঁহার প্রবর্তিত নতুন ধর্মমতের কাহিনী। ধর্মের গুজবে কান দিবার আগে সাধুলোকের উচিত ছিল সহজ কয়েকটা সওয়াল অন্তত পেশ করা। ‘ধর্মমত’ জিনিশটা কি পদার্থ তাঁহাদের কি জিজ্ঞাসা করা বিধেয় ছিল না? আকবর যাহা প্রচার করিয়াছিলেন তাহাকে ‘ধর্মমত’ বলা চলে কিনা একথা জিজ্ঞাসা করিতেই বা দোষটা কোথায়? ইচ্ছা করিলে আপনি খানিক আগাইয়া অধিকও জিজ্ঞাসিতে পারেন। যাহাই হৌক ’দিনে এলাহি’ নামক মতবাদটা কি সত্যকার ধর্মমতপদবাচ্য পদার্থ? নাকি ধর্মমতবিশেষের অজস্র সহস্রাবিধ ব্যাখ্যার এক ব্যাখ্যাবিশেষ? প্রযোজনীয় জেরা না করিয়া প্রায় সকলেই একটা গুজবই রটাইয়াছেন। বলিয়াছেন সম্রাট আকবর নতুন একটা ‘ধর্মমত’ চালাইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারত আর বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এখনও এই গুজবটা জারি আছে। অন্তত কিছুদিন আগেও ছিল। বলিতে পারিব না পুরাপুরি লোপ পাইয়াছে কিনা।

আকবর ধর্ম লইয়া ভাবিয়াছেন। তিনি সব সময় সকল আলেমের সহিত একমত হয়েন নাই। আলেমরাও নিজেদের মধ্যে সবসময় একমত হইতে পারেন নাই। ১৫৭৯ সনে ভারতবর্ষের সর্দার আলেমরা একটি ঘোষণাপত্রে দস্তখত করিলেন । ইহাতে বলা হইয়াছিল যে সকল প্রশ্নে আলেমদের মধ্যে কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হইবার সম্ভাবনা নাই সেখানে দশমতের মধ্য হইতে একটি মত বাছিয়া লইবার অধিকার (‘সুলতানুল আদেল’) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের হাতে সংরক্ষিত থাকিবে। এই ‘মাহজার’ বা ঘোষণাপত্রের ঢের অপব্যাখ্যা হইয়াছ্। এয়ুরোপিয়া লেখকরা ইহার অনুবাদ করিয়াছেন ‘ডিক্রি অব ইনফলিবিলিটি’ ( অর্থাৎ বাদশাহি অভ্রান্তির ফরমান)।

আরও একটা প্রশ্ন কেন করা যাইবে না? ধর্মপ্রাণ ভারতীয় মুসলমান আলেমজাতি বা ধর্মপ্রাণ এয়ুরোপিয়া খ্রিস্টান প্রচারকগণ কি কারণে আকবরের ধর্মমত লইয়া এতটা বাড়াবাড়ি করিলেন? তদুপরি মনে রাখিতে হইবে প্রচারকদেরও জাতি আছে, ধর্ম আছে, বর্ণ আছে, আর আছে স্বার্থবুদ্ধি। দেখিতে হইবে আকবর বাদশাহ কোন সময়ে এই নতুন ধর্মমতে মতি দিলেন। কিম্বা জিজ্ঞাসিতে হইবে ইহার আগে আর কি কি কাজে তিনি হাত দিয়াছিলেন। তাহাতে কোথাও কিন্তু নতুন ধর্মমত প্রচারের আলামত নাই। যদি কিছু থাকিয়া থাকে তবে তাহার নাম হইতে পারে নতুন ধর্মনীতি। ইহাই পরে ’সুলেহ কুল’ বা নিরঙ্কুশ শান্তির নীতি নামে সমধিক পরিচিত হইয়াছে।

আকবরের ‘দিনে এলাহি’ জিনিশটা ছিল রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ। এই রাষ্ট্রনীতির অপর নাম ‘সুলেহ কুল’ বা নিরঙ্কুশ শান্তি। নতুন ধর্মমত প্রচার করিতে বসিয়া হাতের রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত বিপন্ন করিয়া তুলিবেন এমন নাদান ছিলেন না আকবর। পার্সিবাল স্পিয়ার ঠিকই বলিতেছেন—আকবর বাদশাহকে এতটা বেকুব মনে করা বোধ হয় ঠিক হইবে না। মনে রাখিতে হইবে রাষ্ট্রই ছিল তাঁহার ভাবনার মধ্যবিন্দু। ধর্মসমন্বয় ছিল আকবরের রাষ্ট্রভাবনার অঙ্গবিশেষ। তাঁহার প্রধান ভাবনা ছিল কি করিয়া সকল শ্রেণী ও জাতির মন পাওয়া যাইবে। আজিকালি ইহার নাম হইয়াছে ‘হেজিমনি’ ওরফে সম্মতিলাভ বা আনুগত্য অর্জনের বিষয়।
অতীতকালে যত রাজা বা বাদশাহ অখিল ভারতবর্ষ একযোগে শাসন করিতে চাহিয়াছেন তাহাদের সকলকেই এই সমস্যার মোকাবেলা করিয়া চলিতে হইয়াছিল। একেত হিন্দু আর মুসলমান এই দুই জাতিকে নতুন কোন একটা ধর্মের ছায়াতলে টানিয়া আনা যেমন সম্ভব ছিল না তেমনি এই দুই ধর্মবিশ্বাসের একটির জায়গায় অন্যটি স্থাপনের কল্পনাও ছিল সমান অবাস্তব। ভারতেতিহাসের আর দশ রাজযোগীর ন্যায় বাদশাহ আকবরও এই দুই সত্যে সমান ওয়াকেবহাল ছিলেন।

আকবর মনে হয় আরও একটা কথা ভাবিয়াছিলেন। রাষ্ট্রের জায়গায় যখন বিশেষ ধর্মমতকে টানিয়া আনা যাইতেছে না তখন দেখা যাউক অন্তত ধর্মের বিশেস জায়গায় রাষ্ট্রটাকে লইয়া গেলে কেমন হয়। হিন্দু আর মুসলমান একে অপরের ধর্মমত মানিবে না ঠিক আছে। তৃতীয় একটা পদার্র্থ মানিতে তো কাহারও আপত্তি থাকিবার কথা নয়। রাষ্ট্র কিম্বা সম্রাটকে মানিয়া লইতে কাহারও বাধা নাই, অন্তত থাকার কথা নয়। বেশ ইহার তাৎপর্য। এই যুক্তি অনুসারে রাষ্ট্রও একপ্রকার ধর্মমত বৈকি। এই ধর্ম ‘ধর্মমতবিশেষ’ নহে, ধর্মনীতি মাত্র। ইচ্ছা হয় বলিতে পারেন ‘সুলেহ কুল’ ‘রাষ্ট্রের নগণ্য ধর্মনীতি’ মাত্র। কোনক্রমেই ইহা এসলাম, নাসারাধর্ম কিম্বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের মতন ধর্মমত গণ্য হইতে পারে না।

আকবর প্রজাসাধারণের নিকট রাষ্ট্রের প্রাপ্য দাবি করিয়াছিলেন। সেই প্রাপ্য শুদ্ধ কর কিম্বা খাজনায় প্রদেয় নহে। সেই প্রাপ্য প্রজাসাধারণের ভক্তি বা আনুগত্য। বাদশাহকে শুদ্ধমাত্র ধর্মীয় ভক্তিতুল্য ভক্তি করিলেই হইবে না। শ্রদ্ধাটাও দেখাইতে হইবে। মাথা নত করিয়া বা সেজদা প্রভৃতি দিয়া ভক্তিপ্রদর্শনের যে রীতি সেকালের ইরানে আর ভারতে চালু ছিল আকবর নিজেও তাহা খানিক এস্তেমাল করিয়া থাকিবেন। ভারতবর্ষ গুরুভক্তি আর পিরফকিরপরস্তির দেশ। আকবরের উপরও তাহার আছর হইয়াছিল হয়তো। হইতেই পারে। এই আছর ইতর আছর নহে, বিশেষ আছর। রাজারা কোন অধিকারে রাজা হইয়াছেন? এই প্রশ্নের জওয়াবে তখন কি এয়ুরোপে কি এশিয়ায় ভগবানের নাম কে না লইতেন! বলা হইত এই বা সেই রাষ্ট্রশাসনের অধিকার এই বা সেই বংশের ভগবানপ্রদত্ত অধিকার। রাজা হইতেছেন ভূপৃষ্ঠে ভগবানের ছায়া। আকবর এই বাক্যে আস্থা রাখিয়া নতুন আর কিবা করিবেন! তিনিও নিজেকে ভগবানের কিছুটা ছায়াসদৃশ ভাবিয়াছেন।

‘ভগবানের ছায়া’ কথাটা এস্তেমাল করিলে রাজাকে ভগবানের সহিত এক করিয়া ফেলা হয় না। ইহাতে বরং রাজাকে আর দশজনের তুলনায় একটা উচা পৃথক মর্যাদা দেওয়া হয় মাত্র। এয়ুরোপ মহাদেশের কোন রাজা না এই সেদিন পর্যন্ত ‘ডিবাইন রাইট’ ওরফে দিব্যাধিকারের দিব্য না দিয়া কর্তৃত্ব করিয়াছেন? এই সত্যেরই একটা অতিরিক্ত প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে। মোগল বাদশাহি পরিবারের সত্যক্ষমতা একেবারে নিঃশেষ হইয়া যাইবার একশত বছর পরও দেখা গিয়াছে সেই যুদ্ধে ভারতবর্ষে ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুরের কর্মচারিরা, হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা, হাতে এনফিল্ড রাইফেল আর মুখে মোগল বাদশাহের নাম লইয়া লড়াই করিতেছে। বাহাদুর শাহ জাফর শুদ্ধ কি বাদশাহ ছিলেন! তিনি অজস্র মানুষের মুর্শিদও ছিলেন। তাঁহার পিরালি ব্যবসায়টা দিব্যাধিকারের ছায়া নহে একথা কে হলপ করিয়া বলিবে! বাদশাহ আকবরের ধর্মবিশ্বাসে এই হিন্দুস্থানি ধারার চলও যে কিছু পরিমাণে অবিকল ছিল তাহাতে সন্দেহ করা চলে না। ধর্মনীতি আর ধর্মচিন্তার মধ্যে কোন জল অচল সুপরিসর কুঠুরি নাই।

আকবরের ধর্মনীতি, পার্সিবাল স্পিয়ার ঠিকই ধরিয়াছেন, মিঠা মিঠা ফলপ্রসব করিয়াছিল। এই ইংরেজ বুদ্ধিমান অবশেষে বলিয়াছেন মোগলেরাই ভারতদেশের প্রথম মুসলমান রাজবংশ যাঁহারা কি হিন্দু কি মুসলমান সকল জাতির নির্বিশেষ ভালোবাসা বা নিরঙ্কুশ আনুগত্য লাভ করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান, সুন্নি আর শিয়া সকল জাতিই মোগল শাসন মানিয়া লইয়াছিল শুদ্ধমাত্র তলোয়ারের ডরে নয়, অন্যকারণে। এই সকল কারণের মধ্যে আকবর শাহের ধর্মনীতিরও একটা জায়গা নিঃসন্দেহে আছে। মনে রাখিতে হইবে যেমন ফল তেমন বিষ! যেমন বন্য ওল তেমন বাঘা তেতুল। এই দুনিয়ায় কোন পদাথর্টাই বা আপনি নিঃখরচায় পাইয়াছেন!

আকবর বাদশাহকে এই ধর্মনীতি বাবদ কিছু দামও গণিতে হইয়াছিল। কুড়াইতে হইয়াছিল গোঁড়া আলেমদের কাঁড়ি কাঁড়ি অভিসম্পাৎ।

দোহাই
১। M. Athar Ali, ‘Sul-i Kul and the Religious Ideas of Akbar,’ in Mughal India: Studies in Polity, Ideas, Society, and Culture, 6th imp (New Delhi: Oxford University Press, 2011), pp. 158-172
২। Percival Spear, A History of India, vol. 2 (Harmondsworth, Middlesex: Penguin Books, 1965)


সলিমুল্লাহ খান
: লেখক ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ ।