জামাল স্যারকে নিয়ে কয়েক টুকরো স্মৃতি

. আরশাদ মোমেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2013, 12:55 PM
Updated : 19 March 2013, 12:58 PM

আমি জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের সরাসরি ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও তার সান্নিধ্য ও স্নেহভাজন হওয়ার সৌভাগ্যের কারণে আমার ভেতরে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে । তার নাম প্রথম শুনি অগ্রজপ্রতিম (বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক) ড: শাহীন ইসলামের কাছে- তখন আমি সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া মাড়ানোর প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। তাঁর সম্পর্কে বিশদ কিছু না জানলেও অন্তত এটুকু জানতাম যে উনি লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে পরিবারসহ ফেরৎ চলে এসেছেন এবং মহাবিশ্বের সুদুর ভবিষ্যৎ নিয়ে মৌলিক কাজ করে যাচ্ছেন। স্যারের সাথে পরিচিত হওয়ার খুব ইচ্ছে হলেও চট্টগ্রাম শহর বা বিশ্ববিদ্যালয় কোনোটিতে যাওয়ার পারিবারিকভাবে অনুমতি না মেলায় জামাল স্যারের সাক্ষাৎ পেতে আমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। বলতে গেলে একপ্রকার কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের সাক্ষাৎ ঘটে আাশির দশকের শেষের দিকে। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করেছে –আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রায়শই সুদীর্ঘ “এরশাদ”-ভ্যাকেশন ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু টানা ছুটিতে মন ভালো লাগে না; কতই আর মহল্লার মাঠে ক্রিকেট খেলে সময় কাটানো যায়। তাই মাঝমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধুবান্ধব আর স্যারদের সাথে দেখা করি। এরকম একদিনেই দেখা হয়ে গেলো প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সাথে হারুণ স্যারের ( আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর এ. এম. হারুণ-অর-রশীদ ) রুমে। সৌম্যদর্শন সদা স্মিত হাসির মানুষটিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেলো। হারুণ স্যারের কাছে আমার পরিচয় জানার পর আমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন – কী পড়ছি। আমতা আমতা করে জানালাম যে – জেনারেল রিলেটিভিটি শেখার চেষ্টা করছি। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী প্রশ্ন – “কোন বই পড়ছো?”।


এখানে বলে রাখা ভালো ইন্টারনেটের বদৌলতে বর্তমান উৎসাহী বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপে এখন শত শত বইয়ের সফটকপি থাকে – আাশির দশকের শেষেও বিজ্ঞানের বই এতটা সহজে পাওয়া যেতো না । তখন সবেধন নীলমণি আমাদের হাতের কাছে ছিলো –হারুণ স্যারের ব্যক্তিগত সংগ্রহের স্টিভেন ভাইনবার্গের বইটা। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার পুরো বইটা ঐ যুগে ফটোকপি করাও ছিলো পদ্মা সেতু তৈরী করার মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার ( ঐ সময়ে প্রতিটি পৃষ্ঠা ফটোকপির জন্য ২ টাকা লাগে – যখন কুর্মিটোলা – ফার্মগেট বাস ভাড়া ছিলো ২.৫০ টাকা ) । তাই “এরশাদ”-ভ্যাকেশনের উপর ভরসা রেখে ঠিক করলাম পুরো বইটা হাতে কপি করবো এবং হারুণ স্যারকে প্ল্যানটা জানানোর পর স্যার তার বইটা এক “এরশাদ”-ভ্যাকেশনের জন্য ধার দিলেন। আমিও খুব উৎসাহের সাথে সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে কোরান কপি করার স্টাইলে তিনটি মোটা নোটখাতায় বইটির প্রতিটি অধ্যায় কপি করে ফেলি। ফলশ্রুতিতে জামাল স্যারের সাথে আমার যখন সাক্ষাত হয় তখন আমার শুধুমাত্র এই বইয়ের সাথেই পরিচয় ছিলো। বইয়ের নাম শুনেই জামাল স্যার বললেন “ও বইতেতো রিলেটিভিটি আধুনিক জ্যামিতির ভাষায় প্রকাশ করা নেই”। তাই উনি আমাকে বার্নার্ড শুটজের লেখা একটি বইয়ের নাম বললেন যার একটি ফটোকপি তিনি হারুণ স্যারের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন। আমার খেদ, স্যারের পাঠানো ফটোকপিটি হারিয়ে ফেলেছি। অবশ্য বর্তমানে ইন্টারনেটের বদাণ্যতায় বইটির সফটকপি আমার সংগ্রহে আছে। প্রথম পরিচয়েই জামাল স্যারের বদান্যতার যে উদাহরণ পেলাম – তাতে তার সম্পর্কে যে ধারণা আমার মনে তৈরি হলো তার সম্যক প্রমাণ পরবর্তীতে বহুবার পেয়েছি ও শুনেছি।

এর বছর কয়েক পরে যখন আমি যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাজুয়েট স্কুলে ছাত্র হিসেবে যোগদান করলাম তখন আমার রিলেটিভিটি কোর্সের শিক্ষক রাফায়েল সর্কিন (বর্তমানে ক্যানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউটে কর্মরত) জানতে পারলেন যে আমি বাংলাদেশ থেকে আগত ছাত্র। তিনি আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি কখনো জামাল নজরুল ইসলামের নাম শুনেছি কিনা। আমার বিশদ উত্তর শুনে রাফায়েল যাতে সবচেয়ে বিস্মিত হলেন তা হলো জামাল নজরুল ইসলামের মতো সুনাম ও খ্যাতিসম্পন্ন লোক কেন বাংলাদেশে ফেরৎ গেলেন? পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে রাফায়েল সর্কিন ও জামাল নজরুল ইসলাম দু’জনই সত্তুরের দশকে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে কর্মরত ছিলেন এবং সেই সুবাদে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব। আর এরপর থেকে ঢাকায় গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরৎ গেলেই রাফায়েল বরাবরই জামাল স্যারের কথা জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার জামাল স্যার ও কম্পিউটারের মাঝে একধরণের বিকর্ষণ প্রক্রিয়া কাজ করতো। তাই, ইন্টারনেটের মাধ্যমে রাফায়েল বা অন্যান্য বন্ধুদের সাথে সহজে যোগাযোগ করার পরিবর্তে বরাবরই জামাল স্যার তার প্রিয় ছোট্ট টাইপরাইটারের উপর নিয়মিতভাবেই নির্ভরশীল ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণা কেন্দ্রে যাওয়া যতগুলো নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছি , বলার অপেক্ষা রাখেনা যে তা স্যারের টাইপরাইটার ব্যবহার করেই লেখা।

ইন্টারনেটের মতোই স্যারের মোবাইলের ব্যাপারে যে অসহিষ্ণু ছিলেন তার প্রমাণ পেয়েছিলাম গত বছরের চট্টগ্রামে বিভাগীয় পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়েডে। জামাল স্যার ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। পুরস্কার বিতরণী পর্বটি ছিলো শুক্রবারে জুমার নামাজের পরপরই । কিন্তু নানাবিধ কারণে এবং পূর্বের অনেক বক্তারা থাকায় অনুষ্ঠানটি বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়।

অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগিরা সারাদিন ধরে মিলনায়তনে অবস্থান করে ক্লান্ত থাকলেও জামাল স্যারের সুদীর্ঘ বক্তৃতা না শুনে কেউই বেরিয়ে যায়নি। দেশের তরুণদের বিজ্ঞানে আকৃষ্ট করার তার একটি স্বপ্ন ছিলো এবং তার ধারণা ছিল বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কেবল টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদির দিকে বেশী নজর দেয় এবং এ কারণে তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে ।

ঐদিনের প্রধান অতিথির ভাষণের এক পর্যায়েতো তিনি একবার বলেই ফেললেন – “তোমাদের মোবাইলগুলো পুকুরে ফেলে দাও”। তিনি নিজে যে ক্যালকুলেটর আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন না সে ব্যাপারটা ছিল সর্বজনবিদিত।

নিজে জটিল গণিত নিয়ে কাজ করলেও স্টিং তত্ত্বের মতো উচ্চাভিলাসী তত্ত্ব তার অপছন্দ ছিলো। বরাবরই তার বক্তব্য ছিলো – যেখানে আমাদের পরিচিত গন্ডিকেই আমরা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারিনি সেখানে অপরিচিত ও অপরীক্ষিত জগতে পা বাড়ানো হবে অবিবেচকের কাজ। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে আমি আমার বক্তৃতায় গ্লাসহাও-সালাম-ভাইনবার্গ তত্ত্বের গন্ডির ভেতরেই নতুন ধরণের ঘটনা সংঘটনের সম্ভাবনা আলোচনা করেছিলাম। স্ট্রিং-তত্ত্ব ছাড়াও যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে নতুন ধারণার কিছু করা সম্ভব সেটা তাকে দেখাতে পেরে আমারও ভালো লেগেছিলো। যদিও তার খ্যাতি ছিল মূলত তার মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে গবেষনার জন্য ( যার সম্পর্কে বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তার বইগুলোতে সে সম্পর্কে লিখেছেন ) – বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি কখনই জামাল স্যারের সাথে এ ব্যাপারে আলাদা করে আলোচনা করার সুযোগ পাইনি – এটাও আমার জীবনের একটা বড় খেদ হিসেবে রয়ে যাবে।

একবার এক জনপ্রিয় বিজ্ঞান বক্তৃতা দেয়ার সময় মিলনায়তনে বিদ্যুৎ চলে গেলে স্যার ঐ ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই পুরো এক ঘন্টাই বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। স্যারের যে রবীন্দ্রনাথের কত কবিতা ঠোঁটস্থ ছিলো তার একটা প্রমাণ আমি সেদিন হাতেনাতে পেয়েছিলাম।

তার বিশেষ পছন্দ ছিলো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের চারটি কঠিন সমস্যা যার সম্পর্কে তিনি দেশে বিদেশের নানা বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। তার জীবনের সুদীর্ঘ চল্লিশটি বৎসর তিনি এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। সমস্যাগুলো পদার্থবিজ্ঞানের বিশাল গন্ডীর মাঝেই ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিস্তৃত হলেও একমাত্র জামাল নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তির পক্ষেই এই ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোতে সাবলীলভাবে বিচরণ করা সম্ভব ছিলো। তিনি বরাবরই চাইতেন নতুনরা পেছনে ফেলে আসা এই চারটি সমাধান না হওয়া প্রশ্নগুলো নিয়ে নাড়া-চাড়া করুক। এর মধ্যে একটি সমস্যা ছিলো – মাধ্যাকর্ষণের জন্য উৎসহীন আইস্টাইনের সমীকরণের জন্য সার্বজনীন সমাধান বের করা। আমরা যেখানে দু-তিন পাতার চেয়ে বেশী লম্বা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের হিসাব করতে গেলেই কম্পিউটারের শরনাপন্ন হই সেখানে জামাল স্যার তার এক বক্তৃতায় শুধু একটি সমীকরণই দেখিয়েছিলেন যা ছিলো দশ পৃষ্ঠা লম্বা ! দিব্যদৃষ্টি ছাড়া এরকম লম্বা সমীকরণ সমাধান করা একেবারেই অসম্ভব। কম্পিউটার শুধুমাত্র সেই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে যেগুলোকে একটা গৎবাধা নিয়মের অধীনে ফেলা যায়। এই দিব্যদৃষ্টি শুধুমাত্র কাগজ ও কলমের সুচিন্তিত ব্যবহারের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। একারণেই বোধহয় জামাল স্যার বরাবরই কম্পিউটার ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত ছিলেন।

বিদেশ থেকে দেশে ছুটিতে এসে যারাই জামাল স্যারের সাথে দেখা করেছেন তিনি তাদের সবাইকেই টানা পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ না করে দেশে ফিরতে বলতেন। তার পর্যায়ের খ্যাতিসম্পন্ন লোক যদি বিদেশী নিশ্চিন্ত জীবনের লোভ আর মোহ ত্যাগ করে নিজেকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করতে পারেন তবে আমাদের মতো সাধারণ ব্যক্তিরা কেন ব্যক্তিগত লাভের উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য সময় ব্যয় করতে পারবো না? জামাল স্যারের মতো নিবেদিত ও নির্মোহ বিজ্ঞান-সাধক আরো কেন আমরা সমাজে পাচ্ছি না তা জাতি হিসেবে আমাদের ভেবে দেখা অত্যন্ত প্রয়োজন।

তার মাপের বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আমরা বাংলাদেশে আমাদের মাঝে পুনরায় কবে পাবো তা অবশ্যই একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। তাই সবশেষে প্রস্তাব করছি – জামাল স্যারের নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটির নাম তার স্মৃতিতে পরিবর্তন করে “জামাল নজরুল ইসলাম রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথেমেটিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস” রাখা হোক। মৃত্যুর পরে অন্তত এই ন্যূনতম সম্মানটুকু তাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দিতে আশা করি পিছপা হবে না।

আরশাদ মোমেন: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।