জরা ও যৌবনের লড়াই

মাস দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরব বসন্ত নিয়ে একটি কনফারেন্সের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে নানা দেশের বিশেষজ্ঞরা ছিলেন।

. ড. ইমতিয়াজ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2013, 11:50 PM
Updated : 25 Feb 2013, 01:04 AM

একটি প্যানেলে বাংলাদেশ থেকে আমরা তিনজন ছিলাম। আমার সঙ্গের দুজনের একজন একটি পত্রিকার সম্পাদক, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ফরাসী এক বিশেষজ্ঞ আমাদের কাছে জানতে চাইলেন যে, বাংলাদেশে কোনো আরব বসন্তের সম্ভাবনা আছে কিনা। আমার চেয়ে বয়সে নবীন আমার প্যানেলের বাকি দুজনই বললেন যে, ‘এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের দেশে নব্বইয়ে একটি আরব বসন্ত হয়ে গেছে। এখন আমাদের রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক।’

একটু হোঁচট খেলাম। ওদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। আমার পালা এলে তাই বললাম, ‘বাংলাদেশে শুধু একটি নয়, একাধিক আরব বসন্তের সম্ভাবনা রয়েছে।’ আমার সামনে বসেছিল যে তরুণ শিক্ষার্থীরা, তারা এ কথায় উৎফুল্ল হয়ে উঠে করতালি দিল। আমি ফের বললাম, ‘তরুণদের এ করতালি দেখে বোঝা গেল, আমার কথাটা যৌক্তিক।’

ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, আরব বসন্তের উদাহরণ থেকে আমাদের রাজনীতিবিদদের কিছু শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের যে ঢেউ লেগেছিল- তার মধ্যে দুটি বিষয় ছিল লক্ষ্যণীয়। একটি হল, তরুণদের এক জায়গায় একসঙ্গে থাকা। দ্বিতীয়টি হল, তরুণদের এ জমায়েত চলছিল প্রযুক্তির মাধ্যমে। আগে যে ধরনের মাধ্যমগুলো তরুণদের মধ্যে সংযোগ ঘটাত, গত পাঁচ-সাত বছরে সেখানে বড় একটি পরিবর্তন এসেছে। দেশে এখন মোবাইল সংযোগের সংখ্যা নব্বই মিলিয়নেরও বেশি। এর মধ্যে পঁচিশ মিলিয়নের নেট-সংযোগ আছে। কম্পিউটার-ল্যাপটপ-মোবাইল মিলিয়ে দেশে এখন যে পরিমাণ নেট-সংযোগ আছে তা-ও বিশাল। ২০০০ সালে যে সংখ্যা ছিল এক লাথের মতো, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৫ মিলিয়ন। সবচেযে বড় ব্যাপার হল, ইন্টারনেটের প্রযুক্তি তরুণরা যত সহজে আয়ত্ত করতে পারেন প্রবীণরা তা পারেন না। ফলে এর ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণরা পরস্পরের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে পারেন। এসব পরিস্থিতি বাংলাদেশে জাতীয় কোনো ইস্যুতে তরুণদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরব বসন্তের মতো কোনো পরিস্থিতির উদ্ভবের অনুকূলে ছিল।

পাশাপাশি, প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণদের মধ্যেকার লেখক-সত্তার পরিপূর্ণ স্ফুরণের কথাও বলব। প্রথাসিদ্ধভাবে পত্রপত্রিকা বা জার্নালে লেখালেখির ক্ষেত্রে তরুণদের ‘এডিটরিয়াল ব্যুরোক্রেসি’র মধ্যে পড়ে যেতে হয়। সম্পাদকরা তরুণদের লেখায় কম গুরুত্ব দেন। খুব ভালো লেখকদের কেউ কেউ হয়তো কিছুটা সুযোগ পায়। বিপরীতে, প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদিতে তরুণরা অনায়াসে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পাচ্ছে। এখানে তরুণ নিজেই লেখক, প্রকাশক, শিল্পী সবকিছুই। আরও মজার বিষয় হল, তার লেখালেখির জন্য নানা রকম মন্তব্যও সে এখানে পায়। মোবাইল থেকে মোবিলাইজেশনের এ প্রক্রিয়া আগের অনেক কিছুতেই গুণগত পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে তরুণরা কেন এভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিযে পড়ল এর ব্যাখ্যা অনেক। প্রথমত, এখানে ন্যায়বিচারের একটি ইস্যু দীর্ঘদিন অমীমাংসিত ছিল। একাত্তরে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তিন লাখ না ত্রিশ লাখ এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু কোনেটিই নগণ্য কোনো সংখ্যা নয়। এ শহিদদের মধ্যে ছিলেন শিশু, বৃদ্ধ, তরুণ ছাত্র, নির্যাতিত নারী, রিকশাওয়ালা, বুদ্ধিজীবী, গ্রামীণ কৃষিজীবী। মোট কথা, শহিদদের মধ্যে সব পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ ও বয়সের মানুষ রয়েছেন। লাখো নারী ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের শিকার হযেছেন। লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুটতরাজ হয়েছে ব্যাপক।

এত মৃত্যুর মিছিল, এত ধ্বংসের ভয়াবহতার দায় কেউ নেবে না এটা তো হতে পারে না। বিষয়টি তরুণদের মধ্যে একটি প্রশ্ন হয়েই ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি তাদের চেতনায় ছিল। তাই বিচারের উদ্যোগে তরুণরা স্বাগত জানিযেছে। তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ব্যাপারে একটি প্রত্যাশা ছিল।

তবে সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিযে জনমনে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। এগুলো নিয়ে ফেসবুকে-ব্লগে তরুণরা খোলাখুলি আলোচনা করছিল। কয়েক মাস ধরে জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ডাকা, বিক্ষোভ করা এবং এ সময় পুলশের অস্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তা সন্দেহটি ঘনীভুত করছিল। এমনকি কোথাও কোথাও জামায়াতের কর্মীদের মোকাবেলা করতে গিয়ে পুলিশ মার খাচ্ছে এটাও ছিল অস্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বিক্ষোভরত জনতার হাতে পুলিশের নিগৃহীত বা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, জামায়াতের এসব সহিংসতার মাত্র কিছুদিন আগেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে আসা নিরীহ শিক্ষকদের ওপর পুলিশ নির্মম ব্যবহার করেছে যা সারাদেশে প্রতিবাদ ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল।

যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তোলা কিছু প্রশ্নও তরুণদের সামনে ছিল। বিচারপ্রক্রিয়ার মান নিয়ে বাইরে থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছিল, সরকার কেন সেসব নিয়ে ভাবেনি সেটাও একটা বিষয়। প্রসিকিউটরদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা ছিল। সব মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছিলেন তা নিয়ে তরুণদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক ছিল। কাদের মোল্লার মামলার রায় হওয়ার আগে থেকেই তাই একটা শঙ্কার মধ্যে ছিল সবাই।

সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের ইস্যুটিরও ফয়সালা হয়নি। নানা রকম আঁতাত বা সমঝোতার কথা রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছিলেন। এমনকি প্রধান বিরোধী দলেরও অভিযোগ যে, ক্ষমতাসীন দল একতরফা নির্বাচনে যেতে চায়, এবং সেক্ষেত্রে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভুত হতে চায়।

এমন পরিস্থিতিতে কাদের মোল্লার রায় হওয়ার পর তরুণদের ক্ষোভে ফেটে পড়ার কারণটা আমরা সবাই জানি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান এখনও চালু আছে। আমাদের আইনে যেটি সর্বোচ্চ শাস্তি সেটিই তো কাদের মোল্লার মতো যুদ্ধাপরধীর প্রাপ্য ছিল যেহেতু তার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হযেছিল। তারপর মামলার রায় ঘোষণার পর আসামী হাসিমুখে ভি চিহ্ণ দেখিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এ ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এটা কিন্তু জাতির জন্য বড় একটি অপমান। তরুণরা সঙ্গত কারণেই এতে সবচেয়ে বেশি অপমানিত বোধ করেছে।

মনে রাখতে হবে যে, মানুষ অনেক কিছুই সইতে পারে, অপমান নয়। কম খেয়ে, বাসস্থান ছাড়া, না ঘুমিযে থাকা- সবই সম্ভব, কিন্তু কোনো কিছুতে অপমানিত বোধ করলে মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়। তরুণরা যেহেতু প্রযুক্তির দুনিয়ায় তাদের নিজেদের লেখালেখির জগতে একভাবে ক্ষমতায়িত হয়েছে, তাই সে ক্ষমতা দিয়ে তারা মিলিত হয়েছে, প্রতিবাদটা জানিয়েছে।

এ ধরনের আন্দোলনে সাধারণত নেতার কোনো প্রয়োজন থাকে না, এখানে সবাই নেতা। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমরা সবাই রাজা।’ তারপরও একটা নেতৃত্ব এখানে আছে। এটা তারুণ্যের নেতৃত্ব, যা ওভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়; পার্টি বা দলকেন্দ্রিক তো নয়ই। এখানে তারুণ্য নেতৃত্ব দিচ্ছে গানে, শ্লোগানে, কবিতায়।

এ নেতৃত্বের মাধ্যমে তারুণ্য স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, ওরা কী বাংলাদেশ চায়। এখানে আমি বলব, রাজনীতিবিদরাই পিছিয়ে আছেন। তাদের চেয়ে চিন্তায় তারুণ্য অনেক এগিয়ে। তারা পরিবর্তন চায়, ন্যায়বিচার চায়। তাই যতক্ষণ না তারা ন্যায়বিচার পাবে ততক্ষণ মানতে চাইবে না। কারণ যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তারা রাখে। প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক সময়ে আমাদের তরুণরা নতুন নতুন রূপে এসেছে। তাদের এভাবে এগিয়ে আসাটা বন্ধ হবে না। তাই এখন সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন যে প্রবীণরা তাদের এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সবকিছুর দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণ চলে না। রাজনীতিবিদদের উচিত তরুণদের পেছনে যাওয়া।

শেক্সপিয়ারের একটি বিখ্যাত কবিতা দিয়ে শেষ করব, এর নাম ‘ক্র্যাবড এইজ অ্যান্ড ইয়ুথ।’ বাংলায় বলা যায়, ‘জরা ও যৌবন।’ শেক্সপিয়ার বলছেন, ‘জরা ও যৌবন একসঙ্গে থাকতে পারে না।’ আসলে এখানে রূপক অর্থে এটা বলা হয়েছে। মূলত পুরনো আর নতুনের মধ্যে লড়াই সবসময় সব যুগেই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। নতুন বা নবীনই কিন্তু এ লড়াইযে জিতে যায়। কারণ যৌবনের নতুন ভাব আছে, নতুন গান নিয়ে সে এগিয়ে আসে। নতুন চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটায় সে। তাতে এগিযে যায় পৃথিবী।

আমাদের তারুণ্যের সেই নতুন ভাবের জয়গান আমরা এখনই গেয়ে যাচ্ছি। বাকিটা রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।