মৎস্য ভবনের দিক থেকে রাস্তাটা বন্ধ। ভেবেছিলাম এটুকু রাস্তা হেঁটেই যাব। এক রিকশাওয়ালা আমাকে দেখে ডাক দিল। ‘স্যার, শাহবাগে যাবেন তো, আসেন।’ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রিকশায় উঠে ভাবলাম তার সঙ্গে একটু আলাপ করি। যেতে যেতে সে জানাল, গতকাল অনেকের কাছ থেকে সে রিকশাভাড়া বাবদ কোনো পয়সা নেয়নি। এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। এমন ঘটনার কথা ব্লগে পড়েছি। আজ নিজেই সেটা দেখতে পেলাম, শুনতে পেলাম। বাংলাদেশ কি তাহলে বদলে গেল?
অনেকে ভেবেছিল, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অতীতের ব্যাপার হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর পর এ নিয়ে আর কেউ মাতামাতি করবে না। মাঝখানে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে অল্পসময়ের একটি আন্দোলন ঘাতক-দালালদের বিচারের ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের শোচনীয় ব্যর্থতার কারণে সেটি আর অগ্রসর হতে পারেনি। বরং খোদ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানারকম সন্দেহ। পঁচাত্তর-পরবর্তী ধারার অনুসারী রাজনৈতিক দলগুলো শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খণ্ডিত ও খর্বিত করার চেষ্টা চালায়।
এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পাকিস্তান, তার তৎকালীন আন্তর্জাতিক মিত্র চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঘটনাবলী কিছুটা অস্বস্তিকর। চীন এ মনোভাব থেকে বেরিয়ে এলেও যুক্তরাষ্ট্র পারেনি। তারা মনে করে, একটি নরম ধর্মভিত্তিক দল, বা যাকে তারা বলে মডারেট ইসলাম, সেটি দেশের মধ্যে থাকলে ভালো। তাই তাদের নেতারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে অনেক সময় ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করে। বঙ্গবন্ধুর নীতি থেকে সরে আসা দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও আজকাল কম-বেশি এ ধরনের অভিধায় অস্বস্তি বোধ করে না। এমনিতে আমরা সবাই জানি যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কোথাও দেখা-সাক্ষাত হলে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন না। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নৈশভোজের নিমন্ত্রণসভায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত নেতৃবৃন্দ সহাস্যে আলোচনারত আছেন এমন ছবি বিরল নয়।
এসব কিছুই সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধপ্রিয় নবীন-প্রবীণ মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে আঘাত করে এসেছে। বিশেষ করে একাত্তরে যারা স্বজন হারিয়ে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর ধরে সে ক্ষত বুকে পুষে রেখেছেন তাদের মনোবেদনার কোনো শেষ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মানুষকে ভুলিয়ে রাখার জন্য অতীতে চেষ্টার কমতি দেখিনি আমরা। পাঠ্যপুস্তক থেকে টিভি-মিডিয়া সবকিছুতেই এমন ব্যাখা করা হয়েছিল যেন জিয়াউর রহমানের ঘোষণার দ্বারা হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল- যেন ভারত ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রু- যেন যুক্তরাষ্ট্র ছিল মিত্র- যেন মুক্তিযুদ্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ছিল না, ছিল ‘গৃহযুদ্ধ।’
কিন্তু সত্য ইতিহাসের কী আশ্চর্য শক্তি! এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মাত্র চার বছরের মধ্যে সমগ্র মিডিয়ায় সত্য ইতিহাস একটু একটু করে উঠে আসতে শুরু করে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে গঠিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি মুক্তিযুদ্ধের মোটামুটি সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস সব পাঠ্যপুস্তকে ছবিসহ তুলে ধরতে সক্ষম হয়। যদিও এ ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে একক ও একচ্ছত্র করে দেখানোর ভুল প্রবণতাটি রয়ে গেছে। দুজন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তরুণ প্রজন্মের মণি, তাঁদের জনপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের শিখাটি চেতনার মধ্যে আবার প্রজ্জ্বলিত করেন।
এভাবে আমার ধারণা, দীর্ঘ শীতনিদ্রার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনুকূল এক মনোভাব আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠতে শুরু করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম অনেক ঘটনা দেখা গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসি বাহিনির বিরুদ্ধে যে জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তাতে জনগণ এত বছর পরও নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে, জনযুদ্ধের গৌরবগাথা ওরা ভুলতে পারেনি। তাই আমরা দেখতে পাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনেক পরে রাশিয়াতে ‘ব্যালাড অব আ সোলজার’ বা যুক্তরাষ্ট্রে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ নামের ছবি তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধভিত্তিক এসব ছবি এখনও সমান আবেগ নিয়ে দেখে মানুষ। এই কিছুদিন আগে আমাদের দেশে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তৈরি করেছেন ‘গেরিলা’ নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ছবি।
তার মানে, শাসক-শ্রেণি চান বা না চান, এসব ঘটনা নবীন প্রজন্মের নরম মনে গভীর রেখাপাত করে। বর্তমোনে অনেক শিশুরই প্রিয় খেলা হচ্ছে পাক হানাদার বাহিনির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলা। বস্তুত, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে জয়লাভ করেছে তার পেছনে ছিল নবীন প্রজন্মের ভোটের উল্লেখযোগ্য শক্তি। নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তাই তারা ক্ষমতায় আসার চার বছরের মাথায়, অনেক দেরি করে হলেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। যদিও এতে আওয়ামী নেতৃত্বের আশঙ্কা থেকে যায় যে, এর ফলে জামায়াতপন্থী ভোটগুলো বিএনপির ভোটবাক্সে চলে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ এলে প্রশ্ন উঠে, একাত্তরের মূল শত্রু পাকিস্তানি বাহিনির বন্দী ১৯৫ জনকে ক্ষমা করার পর, দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার যুক্তি কী? অনেকে যেমন বলেন, বাঘকে শাস্তি না দিয়ে ফেউকে শাস্তি দেওয়ার মানে কী?
আমি এ মতে বিশ্বাস করি না। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে বাঙালি বা ভারতীয় যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ঘটনাটি ঘটেছিল। তখনই একটি আইন করে ঠিক করা হয়েছিল যে, যদিও ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী পাকসেনার বিচার করা সম্ভব হল না কিন্তু যুদ্ধকালে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি ফেউবাহিনির যে সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের বিচার ঠিকই হবে। সে অনুযায়ী ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে গোলাম আযম তথন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কাদের মোল্লা গং মাটির তলে লুকিয়ে গিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও তখন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
তারপর পঁচাত্তর-পরবর্তীতে ইতিহাস কীভাবে পাল্টে গেল, সেখানে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে আপোষরফা করলেন সে ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যে ইতিহাস সবসময় শেষ বিচারে এর যৌক্তিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। এর গতিপথ সর্পিল বা আঁকাবাঁকা হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত এর গন্তব্য হয় আগের চেয়ে উন্নত।
এত বছর পর আমরা দেখছি, ইতিহাস তার ঋণ শোধ করতে শুরু করেছে। জনগণ চায়, ৩০ লাখ মানুষের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, তাদের মৃত্যুদণ্ড হোক, এবং যারা স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তান কায়েম করতে চায় তারা পাকিস্তানে চলে যাক, তাদের কাজকর্ম দমন ও নিষিদ্ধ করা হোক। এ দাবিগুলো বিশেষ করে তরুণ কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তারা আমাদের বয়োজেষ্ঠ্য রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনছেন না। নিজেরা এগিয়ে এসে শাহবাগ স্কোয়ারে এক অপূর্ব ঐক্যবদ্ধ বহুত্ববাদী মঞ্চ গড়ে তুলেছেন। এ মঞ্চের ন্যূনতম দাবি হচ্ছে রাজাকারদের ফাঁসি। এ থেকে বোঝা যায়, চল্লিশ বছরের কমবয়সী এ ছেলেমেয়েরা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের ক্ষোভ ও বেদনা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছেন। নেতাদের ব্যর্থতাকে ধিক্কার দিয়ে তারা নিজেরাই নতুন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে যে, এখন পর্যন্ত এ মঞ্চ বিভক্ত হয়নি। (ছোটখাট দুয়েকটি উপমঞ্চ গড়ে উঠলেও তা আবার মূল মঞ্চে ফিরে আসছে।) এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র বা সরকার এ মঞ্চ আক্রমণ করেনি। যদিও কোনো কোনো সরকারি নেতা এখানে বক্তব্য দিতে এসে সমাদৃত হননি। মূল অসুবিধা যেটি দাঁড়িয়েছে তা হল তাদের দাবি কীভাবে আদায় হবে এর একটি আইনি রাস্তা খুঁজে বের করা। বিশেষ করে সম্প্রতি ঘোষিত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় তরুণরা মেনে নিতে পারেননি। একই ধরনের অপরাধে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি হল, অথচ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে ফাঁসি দেওয়া হল না- তাকে গুরু পাপে লঘুদণ্ড দেওয়া হল- এর ফলে জনমনে নানা সন্দেহের উদ্রেক করেছে।
এখনও গোলাম আযম ও দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মতো ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাকি রয়ে গেছে। এ বিচারগুলোর ঈপ্সিত রায় এলে হয়তো জনগণের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হত। ইউরোপে যেমন নাৎসিদের বিচার শুরুর আগেই মোটামুটি সব মানুষ ধরে ও ভেবে নিয়েছিলেন যে, তাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, এবং শেষ পর্যন্ত গ্যাস চেম্বারে দিয়ে নাৎসিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল- এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটুক এ আশা এখানেও সবার ছিল।
ইউরোপ এখন ক্যাপিটাল পানিশমেন্টে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমরা তো এখনও ইউরোপ হয়ে যাইনি। ইউরোপের উদ্দেশে আমি বলব, স্মরণ করুন নাৎসিদের অত্যাচারে নিহত নিজেদের পিতামাতার কথা- এরপর বাংলাদেশকে শান্ত হতে বলতে পারবেন কি?
বাংলাদেশে অনেকেই, বিশেষ করে যারা একাত্তর দেখেনি তারা বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতের তরুণ ক্যাডারদের এ ধরনের বিভ্রান্তি খেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এ তরুণ ইসলামী ক্যাডারদের সঙ্গেই একত্রে বেড়ে ওঠা তরুণদের বেশিরভাগই ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। এটাই বাংলাদেশের বিশাল শক্তি।
রাতের বেলা যারা শাহবাগ স্কোয়ারে যান তারা দেখবেন বারডেমের চিকিৎসকরা সেখানে কাজ ফেলে নেমে এসেছেন। দেখবেন আশেপাশের দোকানদাররা সমাবেশের তরুণদের খাবার-পানি সরবরাহ করছেন। দেখবেন উচ্চবিত্ত ঘরের একটি ছেলে গ্রামের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছেলেকে বলছে, ‘তুমি থাকো, তোমার খাবার ও পানির জোগান আমি দেব।’ শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার মধ্যরাতে শাহবাগে হাজির হয়ে বলছেন, ‘আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখছি।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এই তরুণদের বলছেন, ‘এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব।’
এ জাগরণের মূল কথাটি তাই দাঁড়াচ্ছে এটাই যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো আমরা যদি আবারও শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত সবাই মিলে একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে আমাদের সঠিক জাতীয় পরিচয় পুনরুদ্ধার করতে পারব, এবং এটি করতে না পারলে কিন্তু আমরা এক পা-ও সামনে এগুতে পারব না। অতীত ইতিহাসের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার ভেতর দিয়েই আগামীতে তৈরি হবে এবং এখনও তৈরি হচ্ছে নতুন ইতিহাসের ভিত্তি। নবীন প্রজন্মকে তাই RED SALUTE!
এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।