যে মানুষটি মহাবিশ্বকে গুণতে বসেছিলেন

অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষতম কসমোলজিস্ট এবং গণিতবিদদের অন্যতম। কেমব্রিজ-শিক্ষিত এই মানুষটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমাকে ‘ছিলেন’ লিখতে হচ্ছে। এমন অবশ্য হবার কথা ছিল না, তবে মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। অধ্যাপক ইসলাম আমাদের মাঝে আর নেই। তিনি চলে গেছেন কোন সুদূরের পানে। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর শিক্ষা, গবেষণা-নির্দেশনা সম্বলিত তাঁর সায়েন্টিফিক পেপারগুলি। আর রয়ে গেল তাঁর অনবদ্য বইগুলি।

. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2013, 00:50 AM
Updated : 19 March 2013, 00:50 AM
তাঁর তিনটের মতো বাংলা বই আছে। বাকিগুলো ইংরেজিতে লেখা এবং সেই তিনটের সবকটিই কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে। এও এক অনবদ্য ইতিহাস। এমন সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয় – বিশেষ করে বাংলাদেশে বসে?

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ অচেনা বিশ্বমানের এই মানুষটি জাতির চোখের সামনে দিয়ে জীবনদীপ সাঙ্গ করে চলে গেলেন। আর মিডিয়ারই বা দোষ কী! শোনা যায়, বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের কোনো এক সভায় তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন, যথাসময়ের কিছু পরে তিনি সভায় গেলেন, কিন্তু সভাস্থলের কেউই তাঁকে চেনেন না। বেশ উপেক্ষিত কিছু সময় পর জনৈক অতিরিক্ত সচিব তাঁকে চিনতে সফল হলে কিছুটা আলোকসম্পাত পায় তাঁর উপস্থিতি। এই হলো এই পোড়া দেশে বিজ্ঞানীদের অবস্থা!

অথচ এই জামালই যুক্তরাজ্যের সুন্দর চকচকে চাকরি, এলিট ব্রিটিশ সায়েন্স এস্টাবলিশমেন্ট ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন ছেড়ে বাংলা মায়ের ভালোবাসায় দেশে ফিরে আসেন, আলো জ্বালেন তাঁর পৈতৃক ভিটায়, আর আলো জ্বালেন দেশের শিক্ষাঙ্গনে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি অলোকসামান্য প্রতিষ্ঠান। আমাদের মনে রাখতে হবে, অধ্যাপক ইসলাম লোকান্তরে চলে গেলেও তাঁর নিজের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি আজো রয়ে গেছে। এর সম্ভাবনাটুকুর পূর্ণ নির্যাস যদি আমরা নিতে না পারি, তাহলে সেটা হবে আমাদের আরো একটি জাতীয় ব্যর্থতা। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে, একজন জামাল নজরুল ইসলাম তৈরি করতে একটি পরিবারের অনেক কালের সযত্ন পরিচর্যা লাগে, একটা পরিবেশ লাগে। জামাল নজরুলরা হাজারে হাজারে জন্মায় না। জামাল নজরুলরা শ্রেষ্ঠ কাব্যের মতো, যাঁরা ‘বিতরিত হবার নয়’। আমরা যে একটি ‘জামাল নজরুল’ পেলাম তাঁকে তো হেলায় হারালাম, আরেকটি ‘জামাল নজরুল’ পেতে আমাদের আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলার এই ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যটিকে’ আমি প্রথম দেখি নব্বুইয়ের দশকে বিজ্ঞান যাদুঘর আয়োজিত ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান বক্তৃতামালায়’। চমৎকার সুদর্শন মানুষটি ঝরঝরে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন, বাংলায় অতোটা সড়গড় ছিলেন না। তাঁকে খুব কাছে না পেলেও তাঁর কয়েকটি বই ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। ব্যক্তিগত কথোপকথনে তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য অমায়িক মানুষ, বিলেত-শিক্ষিতরা যেমনটি বলে থাকেন ‘সাচ আ জেন্টলম্যান’! একটা দৃশ্য মনে পড়ে – বিজ্ঞান বক্তৃতা শেষে অধ্যাপক ইসলাম সবার সাথে প্রশ্নোত্তর অথবা কুশল বিনিময় করছেন, এমন সময়ে ওঁর আত্মীয় প্রয়াত সেলিনা বাহার জামান এসে আলতো করে ওঁর পিঠে হাত রাখলেন, বললেন ‘জেম্যাল’, অধ্যাপক ইসলাম অতঃপর পারিবারিক আলোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন। এমনি পরিপাটি ছিলেন মানুষটি।

আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল, এমন সব স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে শর্ট ডকুমেন্টারি বানানোর। এমনই একটি প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ ইউনেস্কো এবং আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফান্ডিং অর্গানাইজেশনকে। আমার প্রস্তাবে এমনটি ছিল যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবনী নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি বানিয়ে সেটা স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের দেখানো হবে। যে তিনটি নাম প্রস্তাব করেছিলাম, তার মধ্যে একটি ছিল ‘জামাল নজরুল ইসলাম’। কিন্তু কেউই সেই সামান্য প্রস্তাবে কর্ণপাত করেননি। করলে এই অসামান্য মানুষটির কিছু স্মৃতি সেলুলয়েডে ধরে রাখা যেতো। কিন্তু আজ তো কোটি টাকাতেও তা সম্ভব হবে না। আহারে!

জামাল নজরুল ইসলামের প্রথম জনবোধ্য গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় লেখা। বইটির নাম দ্য আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স, প্রকাশকাল ১৯৮৩, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। এই গ্রন্থটি তাঁকে জগতজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এমনকি বইটি কয়েকটি বিদেশী ভাষাতেও মুদ্রিত হয়েছে। এই বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,

“১৯৭৭ সালে ‘কোয়াটারলি জার্নাল অব দ্য রয়াল অ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটি’তে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের টেকনিকাল পেপার লিখি যার নাম ছিল ‘পসিব্‌ল আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’। আমার কয়েকজন সহকর্মী এই পেপারটিকে বেশ পছন্দ করলেন। ঠিক তখনই ওয়েইনবার্গের অসাধারণ বই দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস প্রকাশিত হয় এবং তখন আমার মনে হলো মহাবিশ্বের পরিণতি সম্পর্কে একটি বই থাকলে বেশ হতো।”

তার পরিণতিতেই মহাবিশ্বের নিয়তি সংক্রান্ত উক্ত গ্রন্থটি তিনি লিখে ফেলেন এমন পাঠকের জন্য ‘যার বিজ্ঞান-বিষয়ক তেমন কোনো জ্ঞান নেই।’ তবে বইটিতে কোনো অতিসরলীকরনের প্রচেষ্টা নেই – ‘তার অর্থ বইয়ের কোনো কোনো অংশে বিজ্ঞান-না-জানা পাঠকের গভীর মনোযোগের দরকার হবে।’ কিন্তু তারপরও বলা যায়, এই বইটির আন্তর্জাতিক প্রচারই অধ্যাপক ইসলামকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং সাধারণ্যেও সুপরিচিতি এনে দিয়েছিল।

এই নাতিদীর্ঘ বইটি মহাবিশ্বের দীর্ঘ মেয়াদী ভবিষ্যতের এবং তার পরিণতির একটি প্রাথমিক ধারণা সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে ধরে। এর ভাষা সরল। কিন্তু মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্যের দিকে এই বইটি সহজেই পাঠককে নিয়ে যায়। সত্যি বলতে কি, অধ্যাপক ইসলামের উপরোক্ত ১৯৭৭-পেপারটি প্রকাশের পরপরই প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের বিখ্যাত অধ্যাপক ফ্রিম্যান ডাইসন একটি পেপার লেখেন মহাবিশ্বের ভবিতব্য এবং তাতে প্রাণসত্তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে (‘টাইম উইদাউট এন্ড: ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োলজি ইন অ্যান ওপেন ইউনিভার্স’, রিভিউজ অব মডার্ন ফিজিক্স, খণ্ড-৫১, পৃষ্ঠা ৪৪৭৩৪৬০, ১৯৭৯)। এই পেপারটি শীঘ্রই এই বিষয়ে ক্লাসিকের মর্যাদা পায়। তাঁর সেই পেপারের সূত্রে এবং ডাইসনের গবেষণার একটি জনবোধ্য ভাষ্য দ্য আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স বইটি। দুঃখজনক যে বইটির বাংলা অনুবাদ হয়নি, এবং এর কোনো সংস্করণও বের হয়নি। এর শেষতম অধ্যায়টি অত্যন্ত চিন্তাশীল এবং জীবনের মূল প্রশ্নগুলোর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেখানে অধ্যাপক ইসলাম লিখেছেন, তাঁর অনবদ্য ইংরেজিতে -
The study of the universe as a whole is a unique enterprise. At least in one sense one is seeking to understand the totality of things. We, as thinking beings, are as much as a part of the universe as are neutron stars and white dwarfs and our destiny is inextricably bound up with that of the universe.

অধ্যাপক ইসলামের আরেকটি সুবিদিত ইংরেজি গ্রন্থ হলো অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিকাল কসমোলজি, প্রকাশক যথারীতি কেমব্রিজ। প্রকাশকাল ১৯৯২ ও ২০০৪। অর্থাৎ, বইটির আন্তর্জাতিক মন্ডলে প্রাসঙ্গিকতা এতো বেশী যে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছে। বইটি মহাকাশকে কীভাবে বুঝতে হবে তার গাণিতিক সৌধ নির্মাণ করে। আকাশকে গণনা করতে হলে এ বইটি কাজে লাগবে। জেনারেল রিলেটিভিটি থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের কয়েকটি মডেল এখানে আলোচিত হয়েছে। বইটি নিঃসন্দেহে মহাকাশ গবেষণার সূচনাবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। তবে কসমোলজি বা বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব শিখতে হলে অন্য আরো কিছু ভালো বই আছে, সেই তুলনায় সমালোচকদের ভাষায় অধ্যাপক ইসলামের এই বইটি অনেকটা ইন্ট্রোডাকটরি রিভিউয়ের মতো কাজে দেবে। তাঁর প্রতিটি বইয়ের ভূমিকাতেই স্যার তাঁর ‘দ্য থ্রি উইমেন ইন মাই লাইফের’ কথা বলেছেন – এঁরা হলেন ওঁর স্ত্রী সুরাইয়া এবং দুই কন্যা সাদাফ ও নার্গিস।

অধ্যাপক ইসলামের প্রথম বাংলা বই কৃষ্ণবিবর; প্রকাশকাল ১৯৮৫, প্রকাশক বাংলা একাডেমী। সুন্দর বাংলায় অত্যন্ত সংক্ষেপে অধ্যাপক ইসলাম এখানে ব্ল্যাকহোলদের প্রকৃতি বাংলার মানুষের জন্য সহজ ভাষায় রচনা করেছেন। এই বইটি ছিল বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহত্তম সৃষ্টি ‘অমর একুশে গ্রন্থমালা’র অংশ। এই গ্রন্থমালার অনেকগুলি বই বাংলায় এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে অনেক বইয়েরই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

কৃষ্ণবিবর বইটিও সেই পর্যায়ের জনপ্রিয়তা পায়, এবং এখন সেটি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের গ্রন্থমালা নতুন করে করবার কোনো পরিকল্পনা বাংলা একাডেমীর আর দেখা যায় না। কৃষ্ণবিবর নিয়ে অধ্যাপক ইসলাম আগ্রহী ছিলেন, কারণ “অনাগত ভবিষ্যতে বিশ্বের কী অবস্থা হবে এবং কী ঘটনা ঘটবে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণবিবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে।”

অধ্যাপক ইসলামের এই ৮৩ পাতার ছোট্ট বইটি বাংলাদেশে ব্ল্যাকহোলের মতো অস্বাভাবিক প্রপঞ্চকে জনবোধ্য করে তোলে।

পাশাপাশি, বাংলায় ব্ল্যাকহোলের একটি চমৎকার পরিভাষাও সংযোজন করে – কৃষ্ণবিবর। শুনেছি এই বইটি লিখতে বাংলার আরেক কিংবদন্তীর বিজ্ঞানী প্রফেসর এ. এম. হারুন-অর-রশীদ যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। বাংলার এই দুই মনীষী কসমোলজিস্ট ছিলেন যাঁরা বাংলার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে মহাকাশকে কীভাবে গণনা করতে হয় তা শেখাতে ব্রতী ছিলেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে কনিষ্ঠজনই ছিলেন জামাল নজরুল! তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর প্রতি প্রফেসর হারুন-অর-রশীদ এক মর্মন্তুদ শোকগাথায় লিখেছেন (বিডিনিউজ ১৮ মার্চ, ২০১৩),”অস্বীকার করার উপায় নাই যে বন্ধুবর জে. এন. ইসলামের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগে আমার জীবনেও “বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব” নিয়ে পড়াশুনা করার উৎসাহ হয়েছে । আমাদের অপূর্ব এই মহাবিশ্ব গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলাম:
“স্টিফেন হকিং তাঁর এ ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম (২০০৫) গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে বোধহয় কিছুটা হতাশ হয়েই লিখেছেন:“আমরা এক পাগল-করা বিশ্ব পেয়েছি। আমরা চারিদিকে যা দেখছি তার অর্থোদ্ধার করতে চাই এবং জানতে চাই , এই বিশ্বের প্রকৃতি ঠিক কী? এখানে আমাদের স্থান কোথায় এবং এই বিশ্ব আর এই আমরা কোথা থেকে এলাম? এই বিশ্ব আমরা ঠিক যেভাবে দেখছি সেটাই বা কেন?” এসব স্টিফেন হকিং-এর যেমন প্রশ্ন , তেমনি তা জে. এন. ইসলাম এবং আমাদেরও প্রশ্ন। দুঃখ এই যে আমাদের অতি প্রিয় জে. এন. ইসলামের সঙ্গে এসব প্রশ্ন নিয়ে আরো আলোচনা করার সুযোগ আর আমাদের থাকবে না।
কিন্তু তবু প্রিয় বন্ধু , আপনি আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে গিয়েছেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।”

কৃষ্ণবিবর বইটির শেষতম অধ্যায়ে অধ্যাপক ইসলাম লিখেছেন-
”একটি কৃষ্ণবিবর অদ্ভুত জিনিস বই কি, কিন্তু তার সম্বন্ধে অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। একটি কৃষ্ণবিবরের কেন্দ্রস্থলে কী ধরনের ঘটনা ঘটে এবং সেখানে পদার্থের কী পরিণাম হয় সেটা অত্যন্ত রহস্যজনক ব্যাপার। কিন্তু যদিও একটি কৃষ্ণবিবরের উদ্ভব বিশ্বের জটিল এবং দুর্বোধ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে গণ্য, তবু তাকে ব্যাখ্যা করতে হলে সবগুলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে বিস্তৃত এবং প্রসারিত করা প্রয়োজন। এটাও মেনে নিতে হবে যে বিশ্বে এমন অসংখ্য জিনিস বা প্রক্রিয়া বিদ্যমান সেগুলো সম্বন্ধে সচেতন হলে অত্যন্ত বিস্ময়কর লাগবে। মহাবিস্ফোরণে যে প্রাণহীন এবং জড় পদার্থ চতুর্দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তার মধ্যে একদিন প্রাণী এবং চেতনার আবির্ভাব ঘটেছিল। এই চেতনায় শ্রদ্ধা জাগে প্রকৃতির বিশালতার প্রতি, এই চেতনায় অনুভূতি জাগায় প্রকৃতির অসীম রহস্য এবং অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য জিনিসকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও আশ্চর্যজনক লাগবে। বিশাল এবং অগণ্য জ্যোতির্লোক, সপ্তর্ষিমন্ডল এবং ছায়াপথ অবশ্যই বিস্ময়কর। কিন্তু একটা পুরাতন পুষ্করিণী থেকে এক বোতল পানি নিয়ে সেটাকে রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করলেও একইভাবে বিস্ময়কর জগতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রকৃতির রহস্য বিশ্বের প্রতিটি অংশে – তা সে ক্ষুদ্রই হোক বা বৃহৎই হোক।”

চট্টগ্রাম শহরের সার্সন রোডের পিয়ানো-বাদক এই নিভৃতচারী অমায়িক বিজ্ঞানীটি মহাবিশ্বের পরিণতি গণনা করতে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব কর্মপরিধিতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন, বিলাতের এলিট বিজ্ঞানী-সমাজের সাথে তাঁর হৃদ্যতা ছিল, মহাকাশের গাণিতিক সৌধ তাঁর নখদর্পণে ছিল; কিন্তু এই অমায়িক মানুষটির কাজ শেষ হয়েছে তা বলা যায় না। তাঁর কাজের ধারাবাহিকতায়, এই দেশকে বিজ্ঞান গবেষণায় উন্নত করতে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করাই আমাদের এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আমাদের তরুণ-তরুণীরা মহাবিশ্বের নিয়তি নির্ধারণী বিজ্ঞান গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হবে নাকি চন্দ্রপৃষ্ঠে কোনো অপমানবের প্রকৃতি সে খুঁজে ফিরবে সেটা এদেশের সমাজকেই ঠিক করতে হবে।
ওমর খৈয়ামের অজ্ঞেয় সূরে –
পৃথিবীর থেকে সাত আকাশের বিস্তৃতি বহুদূর
শনিগ্রহের দুয়ার পেরিয়ে পথরেখা বন্ধুর;
সবই তো বন্দি আমার জ্ঞানের সীমানার বন্ধনে-
তবু অজ্ঞাত মৃত্যু এবং ভাগ্যলিপির সুর।


ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
: বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।