বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ

আমরা একটি উত্থান পর্বে আছি। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ থেকে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম শাহবাগ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা করেছে। সে পুনর্জাগরণে যোগ দিয়েছে আবাল বৃদ্ধ বণিতা।

. ড. মো. আনোয়ার হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2013, 04:51 AM
Updated : 15 March 2013, 04:51 AM
আমরা একটি উত্থান পর্বে আছি। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ থেকে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম শাহবাগ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা করেছে। সে পুনর্জাগরণে যোগ দিয়েছে আবাল বৃদ্ধ বণিতা।

পুনর্জাগরণের অর্থই হচ্ছে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী এক জাগরণ বা রেঁনেসায় অংশ নিয়েছিল। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ এবং সবশেষে ১৯৭১ – এই ২৩ বছর ধরে সে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। এসময়ে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত সংগ্রাম – কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কখনও ছাত্রদের বিজ্ঞানভিত্তিক, সার্বজনিন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম এবং এই পুরো সময় জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উপযোগী সুস্থ-সবল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম – এ সব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের – যার ঢেউ শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ মাসে।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এতদঅঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি সেই ‘৪৮ থেকে শুরু করে ‘৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেবার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে। আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে সামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অমর সেই ভাষণটি ক্যালেন্ডারের একটি তারিখকে মহাকালের দেয়ালে সূর্য চিহ্ন এঁকে দিয়ে অনন্তকালের জন্য ভাস্বর করে দিল – সে’টি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। ২৩ বছর ধরে তিল তিল করে রচিত সংগ্রামের পথ বেয়ে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। যাতে সবচেয়ে ধারাবাহিক, সবচেয়ে দূরদর্শি এবং সবচেয়ে সাহসী নেতৃত্ব এসেছে একেবারে দেশজ, খাঁটি এবং সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা তুলনামূলকভাবে বয়সে তরুণ এক বিপ্লবী নেতার কাছ থেকে – তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ঐ দাবানলের যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগিরা। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে – স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জন রীড রচিত বিশ্বখ্যাত “Days that shook the world” – যে ক’টি দিনে রাশিয়ায় মহামতি লেলিনের নেতৃ্ত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ঐ ১৮ দিন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছিল ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে। তার অব্যবহিত পূর্বে ২৫শে মার্চের কালরাতে নারকীয় গণহত্যা মিশন “অপারেশন সার্চ লাইট” নিয়ে বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জেনারেল টিক্কা খানের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির দিকে তাকালেই ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি বোঝা যাবে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা দেন। ঘোষণার মর্মকথা ছিল একটাই: পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা। ইয়াহিয়া খানের এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটটি ছিল এমন: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫১টি আসন। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ৩৮.৩% মানুষের সমর্থন নিয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট জনসমর্থন নিয়ে জয়লাভ করে ৮১টি আসনে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের পরিষ্কার সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। তার প্রতিফলন ঘটে তার ১লা মার্চের ঘোষণায়। তিনি বলেন :
“The position briefly is that the major party of West Pakistan, namely, the Pakistan People’s Party, as well as certain other political parties, have declared their intenton not to attend the National Assembly session on the third of March, 1971. In addition, the general situation of tension created by India has further complicted the whole position. I have, therefore, decided to postpone the summoning of the National Assembly to a later date”

ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কারণ অনুসন্ধান করলে, ইসলামী পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখন্ডতা রক্ষা থেকে শুরু করে ভারতীয় জুজুর ভয়সহ অনেক কারণই খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে একটি অন্তর্নিহিত কারণ যা পাকিস্তানি শাসকেরা সচরাচর স্বীকার করতেন না, তা ছিল প্রধানত বাঙালি মুসলমানদের প্রতি তাদের মজ্জাগত ‘অশ্রদ্ধাবোধ’। বাঙালি গানের মিষ্টি সুরের প্রশংসা করলেও মোহাম্মদ আইয়ুব খান হয়তো কিছুটা অসাবধানতাবশত তার ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ বইতে বাঙালিদের সম্পর্কে বলেন:

“[...] It would be no exaggeration to say that up to the creation of Pakistan, they had not known any real freedom or sovereignty. They have been in turn ruled either by the caste Hindus, Moghuls, Pathans, or the British. In addition, they have been and still are under considerable Hindu cultural and linguistic influence. As such they have all the inhibitions of down-trodden races and have not yet found it possible to adjust psychologically to the requirements of the new-born freedom. Their popular complexes, exclusiveness, suspiscion and a sort of defensive aggresiveness probably emerge from this historical background.”

এ কথাগুলো নতুন করে তুলে ধরার উদ্দেশ্য একটাই। সকলকে আবারো মনে করিয়ে দেওয়া যে, ১লা মার্চ ১৯৭১ সালে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের মনোজগতের সাথে তার উত্তরসুরী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মনের ভাবনার কোন অমিল ছিল না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলে পাকিস্তানী শাসকদের চোখে ‘down-trodden’, স্বাধীনতার মূল্য উপলব্ধি করতে মনস্তাত্বিকভাবে প্রস্তুত নয় এমন বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা চলে যেত, যা মেনে নিতে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কেউই প্রস্তুত ছিল না। এমন এক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ আরো আক্রমণাত্মক কর্মসূচি ঘোষণার পক্ষে থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং অহিংস ও শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান। হোটেল পূর্বানীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সংসদীয় পার্টির সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এটা দুঃখজনক যে একটি সংখ্যালঘু দলের আবদার রাখতে গিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে।” স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সকলকে অপেক্ষা করতে বলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ৭ই মার্চে রেসকোর্র্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন, যা ছিল: “You will see history made if the conspirators fail to come to their senses.” কি আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই হুশিয়ারী উচ্চারণ বছর শেষ হতে না হতেই ফলে গিয়েছিল। বাংলার মানুষ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে পৃথিবীর বুকে একটি নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়।

স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের বেতার ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা ব্যাপক আকারে এবং স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঢাকার ফার্মগেট, এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র মানুষের মিছিলে গুলি চালানো হয়। আবারো রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। আন্দোলন আর অহিংস অসহযোগে সীমাবদ্ধ থাকে না। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ১২.৪৫ মিনিটে। সেই সমাবেশেই বাংলাদেশের পতাকা প্রথমবারের মত ছাত্র-জনতার সামনে প্রদর্শিত হয়। স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সরাসরি অংশ নিয়ে ছিলেন, আজকে তা আমরা প্রয়াত শহীদ কাজী আরেফ আহমেদের ১৯৯০ সালে এক দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি। সময় দ্রুত এগুতে থাকে। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের জনসভা। সভা থেকে পড়ে শোনানো ছাত্রলীগের প্রথম ইশতেহারে ‘দলমত নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি নরনারীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার আহ্বান’ জানানো হয়। সরাসরিভাবে না হলেও সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেও আমরা স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যয় খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি বলেন, “হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যাতে না থামে। ” ইয়াহিয়া খান ৬ই মার্চে বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের লক্ষে ১০ই মার্চ ঢাকায় একটি গোল টেবিল বৈঠক আয়োজনের কথা জানান এবং ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। তবে ভাষণের শেষভাগে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন,

“Finally let me make it absolutely clear that no matter what happens, as long as I am in command of the Pakistan armed Forces and Head of the State, I will ensure complete and absolute integrity of Pakistan. [...] I will not allow a handful of people to destroy the homeland of millions of innocent Pakistanis. It is the duty of the Pakistan Armed Forces to ensure the integrity, solidarity and security of Pakistan, a duty in which they have never failed.”

ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে এই তথ্যটি উহ্য রাখেন যে গত কয়েকদিনে পূর্ব বাংলার ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ অন্যান্য শহরে পাকিস্তানের ‘integrity, solidarity and security’ রক্ষার নামে পাকিস্তান সশস্র বাহিনী ইতিমধ্যেই বহু নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শোনার পর বঙ্গবন্ধু অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসেন। আলোচনা শেষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ইশতেহার প্রদান করা হয় যা তাজউদ্দিন আহমেদ তৈরি করেছিলেন। ইশতেহারের শেষাংশে বলা হয়: “শহীদদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার রক্ত এখনো শুকোয়নি। শহীদদের পবিত্র রক্ত পদদলিত করে ১০ই মার্চ তারিখে প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না।”

চলে আসে ৭ই মার্চ ১৯৭১। এই দিনটিকে সেদিন যারা সচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেটি ছিল তাদের জন্য এক পরম সৌভাগ্য। কারণ আর কখনো এমন আরেকটি দিন দেখার সুযোগ তাদের সামনে আসবে না। দু’টি পরিবারের সেইদিনকার মনের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কি অধীর আগ্রহে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। কি আছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৭ই মার্চের দিনলিপিতে? শহীদ জননী বলেন,

“আমি যদিও মিটিংয়ে যাব না, বাসায় বসে রেডিওতে বক্তৃতার রিলে শুনব, তবু আমাকেও এই উত্তেজনার জ্বরে ধরেছে। এর মধ্যে সুবহান আমাকে জ্বালিয়ে মারল। আজ তাড়াতাড়ি রান্না সারতে বলেছিলাম। শরীফ বলেছে বারোটার মধ্যে খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে। ঠিক দেড়টায় রওনা দেবে তা না হলে কাছাকাছি দাঁড়াবার জায়গা পাবে না। আর সুবহান হতচ্ছাড়াটা এগারটায় সময় গোশত পুড়িয়ে ফেলল। বারেককে দিয়েছিলাম রুমী জামীদের শার্ট ইস্ত্রী করতে। সুবহান চুলোয় গোস্ত রেখে বারেকের সঙ্গে ইস্ত্রী করতে মেতেছে। তিনিও আজ শেখ সাহেবের বক্তৃতা শুনতে যাবেন, তাই তার নিজের প্যান্ট শার্ট ইস্ত্রী তদারকিতে যখন মগ্ন, তখন গোশত গেছে পুড়ে। [...] এতবড় কাণ্ড করে, এত বকা খেয়েও সুবহানের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রান্নাঘরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে প্যান্ট-শার্ট পরে তিনি শরীফদের সঙ্গে চললেন শেখ সাহেবের বক্তৃতা শুনতে।”

সেদিন পান্না কায়সারের ঘরেও এক অজানা উত্তেজনা। শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সেদিন তাকে বলেন, “তোমার জীবদ্দশায় এমন ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হবে না। চল, কিছুক্ষণ থেকে চলে এসো। আমার ছেলে তার জন্মের আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনবে। তোমার জীবনে এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ” পান্না কায়সার সেদিন না বলতে পারেননি। স্বামীকে নিয়ে তিনিও চলেন পল্টন ময়দানের পথে।

৭ই মার্চের ভাষণ দেয়ার ঠিক আগের কয়েকটি ঘন্টা কেমন কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর? বিভিন্ন বই থেকে ভাষণের পূর্ব মুহূর্তগুলোর খণ্ড খণ্ড চিত্র পাই। তবে নিঃসন্দেহে সবচাইতে নিখুত বর্ণনা আমরা পাই বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে থেকে। ২০০৪ সালে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন,

“আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। এটা ছিল আমার রুটিন ওয়ার্ক। আমি সবসময় করতাম। ভাবতাম এটা না করতে পারলে আমার জীবন বৃথা। আব্বা যখন খাটে শুতেন, বালিশটা নামিয়ে আমার বসার জন্য একটা জায়গা করে দিতেন। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলাম। মা পাশে এসে বসলেন। বললেন, ‘আজ সারা দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে তোমার বাঁশের লাঠি, জনগণ আর পেছনে বন্দুক। এই মানুষদের তোমাকে বাঁচাতেও হবে – এই মানুষের আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে হবে। অনেকে অনেক কথা বলবে – তোমার মনে যে ঠিক চিন্তাটা থাকবে – তুমি ঠিক সেই কথাটা বলবে – আর কারো কথায় কান দেবা না। তোমার নিজের চিন্তা থেকে যেটা আসবে যেভাবে আসবে – তুমি ঠিক সেইভাবে কথাটা বলবা’। এই ছোট্ট কথাটুকু মা আমার আব্বাকে ঐ সভায় যাবার আগে বলে দিয়েছিলেন। ”

এমনই একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি দিয়েছিলেন, এরপর প্রবল চাপের মুখেও পরম ধৈর্য্যে বঙ্গবন্ধু ১৮ দিনের প্রতিটি প্রহর অপেক্ষা করেছেন ২৬শে মার্চের সেই সঠিক ক্ষণটির জন্য। একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশের একাংশকে মূল অংশ থেকে পৃথক করবার দায়ভার নিয়ে বিশ্ব সভা ও বিশ্বজনমতের বিরোধীতার মুখে তাই পড়তে হয়নি বঙ্গবন্ধুকে। বরং নির্মম গণহত্যার শিকার একটি ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী যারা নিরঙ্কুশ ভোটে বঙ্গবন্ধুকে তাদের নেতা নির্বাচন করেছিল, তাদের কাছে এবং বিশ্বজনমতের কাছে ২৬শে মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এসেছিল আক্রান্ত, নিপীড়িত-লাঞ্চিত মানুষের সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত ঘোষণা হিসেবে। তাকে স্বাগত জানাতে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর কোন দ্বিধা রইল না। তবে ৭ই মার্চের ভাষণ এমনই স্বয়ংভূ, এমনিই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে, ঐ ভাষণে করণীয় ও নির্দেশাবলী অনুসরণ করে কোন আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা না করেই জেগে উঠা জনগণ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করবো ভাষণের সেই অমোঘ নির্দেশ,

“আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা ঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। ”

একটা গুলি নয়, গুলি বৃষ্টি, ট্যাঙ্কের গোলা, আর্টিলারী শেল, গ্রেনেড, আগুনে বোমা এবং এমনসব মারণাস্ত্র যা এদেশের মানুষ কখনও শোনেনি, তা বর্ষিত হয়েছিল নিরস্ত্র মানুষের উপর। ২৫শে মার্চের কালরাতে। তাই বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বকর্ণে শোনার জন্য জনগণ অপেক্ষা করেনি। ১৮ দিন ধরে ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নির্দেশ যা বুকের গভীরে ধারণ করেছে দেশবাসী, তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিশ্বব্যাপী যেখানেই ছিল বাঙালি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে সেখান থেকেই প্রতিরোধ যুদ্ধে যাবার প্রহর গুণেছে। সরাসরি রণাঙ্গনে অথবা নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরো মুক্তিযুদ্ধকাল সময়ে মানুষকে উজ্জীবিত রেখেছে। প্রিয় নেতা সুদূর পাকিস্তান কারাগারে। বেঁচে আছেন কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঐ অমর ভাষণ জীবন-মরণের কঠিন দুঃসময়ে এক সঞ্জিবনী সুধার মত বিপন্ন মানুষকে সজিব রেখেছে। ‘বজ্রকণ্ঠ’ – স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য গ্রাম ও শহরের মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করেছে। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি হয়ে গিয়েছিল একটি রণহুঙ্কার। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ঐ নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আর ছিল ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধুর মুখ নিঃসৃত ‘জয় বাংলা’ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণধ্বনি। ঐ ধ্বনি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করেছে পাকিস্তানী সৈন্যদের। মেশিনগানের গুলির মুখে এগিয়ে গেছে, প্রবেশ করেছে শত্রুর বাংকারে। বুকের গভীরে ‘বঙ্গবন্ধু’ আর মুখে ‘জয় বাংলা’ – এইতো ছিল বাঙালির মূল অস্ত্র। এই দু’টো শব্দ তখন আর কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নয়, তা হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঘোর লাগা এক জাতির – গোটা বাঙালি জাতির সবচেয়ে প্রিয় শব্দ।

তারপর মহাবিজয় এসেছে। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরে। ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদান, চার লক্ষাধিক মা-বোনের ধর্ষিত হওয়া, প্রায় ১ কোটি মানুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ, সম্পদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি – এসবের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অমর বাণী “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”- তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জিত হলো।

১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের কালরাত্রি পর্যন্ত ৭ই মার্চের ভাষণ সরকারী প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে বহুবার। তারচেয়ে বহুগুণ বেশি প্রচারিত হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বউদ্যোগে – গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায়, দেশে-বিদেশে। বিশেষ করে তিনটি জাতীয় দিবস – বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে এদেশের মানুষ বড় ভালবেসে, বড় মমতায়, শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বার বার শুনেছে। রোমাঞ্চিত হয়েছে, বিপদে সাহস – সংকটে দৃঢ়তা লাভ করেছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ ছিল দূরহ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও আরও কঠিন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যদিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র – এই রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সম্বলিত একটি সংবিধান বিজয় লাভের মাত্র এক বছরের মধ্যেই দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য উপযোগী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্মলাভ করা স্বাধীন বাংলাদেশের আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করবার মত রাষ্ট্র না থাকায় তার সকল শক্তিকেন্দ্রে সংগঠিত হতে পেরেছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। তারা ষড়যন্ত্র করেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় অংশকে ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিতে পেরেছিল। তাদের হাতে কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে নিহত হলেন জাতির জনকের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা। ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে জীবন দিলেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশ ডুবে গেল নিকশ অন্ধকারে। জীবনান্দ দাশ তেমন আঁধারের কথা কল্পনা করেই হয়তো লিখেছিলেন ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’। আর অন্নদাশঙ্কর রায় লিখলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে’ নামের অবিস্মরণীয় কবিতা। তাঁর কয়েকটি লাইন

“নরহত্যা মহাপাপ তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি যারা তার পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি; অতর্কিতে তারেই নিধন
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর”

“বাংলাদেশ! থেকো নাকো নিরব দর্শক
ধিক্কারে মুখর হও, হাত ধুয়ে এড়াও নরক”

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ – দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমি পদানত থাকল একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের পুনর্বাসনকারীদের দ্বারা। একাত্তরের জাগরণ পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবগাঁথা তারা ভুলিয়ে দিতে চাইল। নিষিদ্ধ হলেন বঙ্গবন্ধু। নিষিদ্ধ হলো তাঁর অমর ৭ই মার্চ ভাষণ। লজ্জায়, ক্ষোভে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের আত্মপরিচয় দেয়া থেকে বিরত হলেন। কিন্তু তারপরও এদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরে লালিত স্বপ্ন একাত্তরকে মুছে ফেলা গেল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণ সরকারী প্রচার মাধ্যমে নিষিদ্ধ হলেও সারা বাংলায় বছর জুড়েই তা বাজতে থাকলো। আর মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন গোটা জাতির সবচেয়ে প্রিয় দু’টি শব্দ ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ শুধু মাত্র আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্র্মীদের মুখে উচ্চারিত হতে থাকলো। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা ৩টি জাতীয় দিবসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতির জনকের শাহাদাত বরণ দিবস। এসব দিবসে দেশজুড়ে শহরে-গ্রামে সড়ক ও রাস্তার পাশে হাটে-বাজারে তাদের উদ্যোগে ৭ই মার্চের ভাষণ বেজেই চললো। যখনই সে ভাষণের কথাগুলো মানুষের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করছে, এক শিহরণ বয়ে গেছে তাদের দেহে।

১৯৯৬ সালের ১২ই জুন বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস রচিত হলো। দীর্ঘ ২১ বছরের অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করলো। সেদিন রাতের কথা মনে আছে। ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। বিটিভি’র সে সময়কার উপস্থাপন সম্পাদক সরকার ফিরোজ উদ্দিনের বলিষ্ঠ উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অমর ভাষণ – ‘ভায়েরা আমার …’ শুনলো দেশবাসী। ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের প্রথম প্রহরে রাত ১২ঃ০৯ মিনিটে এই সরকার ফিরোজ উদ্দিনই অধিবেশন সমাপনী ঘোষণায় বলেছিলেন, “এখন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা বেজে ০৯ মিনিট – আজ ২৪শে মার্চ বুধবার। আমাদের অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি।” ১৯৯৬ এর ১২ই জুন তারিখে বিটিভি’র পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হওয়া মাত্র ‘জয় বাংলা’ বলে আমরা গোটা পরিবার ফজলুল হক হলের বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এক এক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকলো ’৭১ এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোর কথা। পয়লা মার্চ রাতেই ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে আমার নেতৃত্বে ফজলুল হক হলে গঠিত হয়েছে ‘সূর্যসেন স্কোয়াড’। যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছি আমরা। এলো ৭ই মার্চ। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। সূর্যসেন স্কোয়াডের সদস্যদের নিয়ে শুনলাম সেই অমর ভাষণ। ভাষণ শেষে ছুটছিলাম আমরা। কেন ছুটছিলাম আমরা জানিনা। মনে হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সব নির্দেশ আমরা পেয়ে গেছি।

১৯৯৬ থেকে ২০০১। শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর। মনে আছে ৪র্থ বছরের একটি দিনের কথা। ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ’ ময়মনসিংহ শহরের মুসলিম হলে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। আমার পরম শ্রদ্ধেয় আলোকিত মানুষ যতিন সরকারের সভাপতিত্বে সে সভায় বলেছিলাম, “বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে যদি স্বর্ণযুগ বলে কিছু থাকে, তা হলো বিগত পাঁচ বছরের শেখ হাসিনা সরকারের শাসন”। পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু খুনিদের বিচার করা যাবে না, এমন যে ইনডেমনিটি বিধান সামরিক শাসকরা করে রেখেছিল, তা দূর হয় এসময়ে। দীর্ঘ ফৌজদারি বিচারে খুনিদের সাজা হয়। অনেক সাফল্যের মধ্যে এ সময়েই ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর মর্যাদা লাভ করে।

এরপর ফের অপশক্তির নীল-নকশা। বিচারপতি লতিফুর রহমানের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করানো হয়। প্রশাসনিক ও সামরিক কঠিন বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে শতকরা ৪০.০২ ভাগ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ লাভ করে মাত্র ৬২টি আসন। অন্যদিকে শতকরা ৪১.৪০ ভাগ ভোট পেয়ে বিএনপি লাভ করে ১৯৩টি আসন। বাংলাদেশ আবারো নিমজ্জিত হয় গভীর অন্ধকারে। বিএনপি জামায়াতের মানবতা বিরোধী চরম দূঃশাসনে ক্ষত-বিক্ষত হয় ‘জয় বাংলা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ যারা ধারণ করেছিলেন সেই সব মানুষেরা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর হয় না। আবারও মুক্তিযুদ্ধ, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ হয় সরকারি প্রচার যন্ত্রে। পাঠ্যবইয়ে নির্বিচারে চলে ইতিহাস বিকৃতি। প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিএনপি-জামায়াত সরকার ও তাদের গোয়েন্দা বাহিনীর পরিকল্পনায় গ্রেনেড আক্রমণে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের মানববর্ম ও অনেকটা অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪জন নেতা-কর্মী। এর আগে নির্মম হত্যার শিকার হন বাংলাদেশের অন্যতম সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, জননন্দিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। এই দুঃসময়ে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীরা নয়. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন এমন দেশবাসীর প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর অমর ৭ই মার্চ ভাষণ বারবার শুনে সাহসে-সংকল্পে বুক বেঁধেছেন। রচনা করেছেন জামায়েত-বিএনপি’র দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বীরোচিত সংগ্রাম। এরপর আসে সেনা-চালিত তত্ত্বাধায়ক সরকার। পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফের মত এক দীর্ঘস্থায়ী সেনা শাসন চাপিয়ে দেয়ার নীল-নকশা করে তারা। প্রথমেই গ্রেফতার করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এবং পরে বিএনপিনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা বীরোচিত সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তাতে যুক্ত হয় রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষায়তনের ছাত্র-শিক্ষকেরা। সেনা শাসকদের অভিলাষ পূরণ হয় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আপোষহীন দৃঢ়তার কারণে ‘মাইনাস টু ফর্মূলা’ ব্যর্থ হয়ে যায়। সেনা-চালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বেরের নির্বাচনে দেশের ক্ষমতায় ফিরে এলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাঙালি জাতি একাত্তরের চেতনায় নতুন করে সিক্ত হলো। এক নতুন যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ধ্বনিত হতে থাকল দিকে দিকে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই সূচনা হয়েছিল এ আন্দোলন। নতুন প্রজন্ম বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এলো। জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে এলেন দৃঢ়সংকল্পে। গঠিত হলো যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথমে একটি এবং পরে আরেকটি। তবে এর যাত্রা নির্বিঘ্ন ছিল না। পদে পদে ষড়যন্ত্র হতে থাকে, সৃষ্টি হতে থাকা বাধা। শুধু জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মিত্ররাই নয়, প্রশাসনের ভেতর থেকেও চলে ষড়যন্ত্র। তারপরও সরকারের দৃঢ় ইচ্ছার কারণে ট্রাইব্যুনাল কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এর আগে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যে বিচার নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে শুরু হয়েছিল, তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। প্রচলিত বিচারিক প্রক্রিয়াতেই সর্বোচ্চ আদালত বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ফাঁসির দণ্ড প্রদান করে। এ রায় কার্যকর করতে সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত নিঃষ্কম্প থাকে। এর ফলে আইনের শাসনের পথে দেশ নবউদ্যমে যাত্রা শুরু করে।

সংসদে তিন চতুর্থাংশ আসন লাভ করায় মহাজোট সরকারের উপর মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। তেমন সকল প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। তারপরও বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। বিশ্ব অর্থনীতিতে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে মন্দা সত্বেও বাংলাদেশ থেমে থাকল না। উঁচু প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলো। গার্ডিয়ান পত্রিকা ভবিষ্যতবাণী করল, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, মুম্বাইয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, “সামাজিক অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে”। আমাদের সুশীল সমাজ এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকসমূহ যেখানে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার চিত্রই মুখ্য করে তুলে ধরছিলেন, তারা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের সম্ভাবনা দেখতে পারছেন। এসব সম্ভাবনা কি সয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়েছে? সম্ভবতঃ নয়। এর সঙ্গে সরকারের নীতি পরিকল্পনা নিশ্চয় জড়িত আছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সরকারের তড়িৎ বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ফল পাওয়া যাচ্ছে। কৃষিখাতে সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা অসাধ্য সাধন করছেন। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, নতুন বছরে তাদের শ্রমে-ঘামে-স্বপ্নে তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করবে ২০ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিরা নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সমৃদ্ধ রাখছে। এ সময়ে আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে বঙ্গপসাগরের বিশাল এলাকায় আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা, “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”- সত্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এখন সেই সাত কোটি মানুষ ষোল কোটিতে পরিণত হয়েছে। ৭ই মার্চের সেই প্রত্যয় দৃপ্ত ঘোষণা তাদের যে কোনো বাধা অতিক্রমে অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা নতুন নতুন সাফল্য বয়ে আনছে। শুধু ছেলেরা নয়, আমাদের মেয়েরাও এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করছে। নানা ব্যবসা উদ্যোগে এগিয়ে আসছে নতুন প্রজন্ম। বর্তমান সরকার সূচিত ডিজিটাল বিপ্লবের সবচাইতে শক্তিশালী ইঞ্জিন এই নতুন প্রজন্ম। সে বিপ্লবের সুফল কাজে লাগছে নতুন প্রজন্মের মহাজাগরণে। ব্যস্ত ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে হাতিরঝিল স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের দক্ষ পরিকল্পনায় মোহনীয় হয়ে উঠেছে। এমন প্রতিটি বিজয়, প্রতিটি সাফল্য বলে দিচ্ছে, হাজার বছর ধরে অবর্ননীয় দুঃখ-কষ্টে থাকা বাংলাদেশের জনগণকে কেউ আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এক নতুন রেঁনেসার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেছে এই বাংলায়। বঙ্গবন্ধুর অমর ৭ই মার্চ ভাষণের মূল সুরটি অনুসরণ করেই তিল তিল করে তা নির্মিত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ঘটে যায় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এক মহাউত্থান ঘটিয়ে ফেলল, যাতে তারা নিজেরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিল এবং অন্যদেরও উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করে শামিল করে ফেলল। এর শুরুটা হয়েছিল ৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সেদিন আবদুল কাদের মোল্লার মামলার রায় দিয়েছিল। আদালতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম ১২টা ৭ মিনিট। মোট ৬টি অভিযোগের বিবরণ পাঠ করা হয়েছে, ৫টি প্রমাণিত। এর মধ্যে দুটি গুরুতর অভিযোগ, যার মধ্যে গণহত্যাও রয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। কোর্টে আমি মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা লিখে রেখেছি, ‘ডেথ প্রোনাউন্সড’। ১২টা ৮ মিনিটে রায় হয়ে যাবে। কেবল সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু পরক্ষণেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের যে রায় ঘোষণা হলো, তা আমাদের সবাইকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলল। যেখানে হর্ষধ্বনি ওঠার কথা, তার পরিবর্তে নেমে এলো কবরের নিস্তব্ধতা। কেবল খুনি আবদুল কাদের মোল্লা চিৎকার করে উঠল, বক্তৃতা দিল এবং বিজয় চিহ্ন দেখাল। একরাশ ঘৃণা, ক্ষোভ ও লজ্জা নিয়ে বের হয়ে এলাম আদালত থেকে। বাইরে অপেক্ষা করছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা। আমার মতো সবার চোখে-মুখে বিষণ্নতা। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের বললাম, “এ রায় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। যে গুরুতর অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, তার একমাত্র শাস্তি ফাঁসি এবং কোনোভাবেই যাবজ্জ্বীবন কারাদণ্ড হতে পারে না।” আমি আদালত অবমাননার ঝুঁকি নিয়েই কিছু কথা বলি। তবে গভীর বেদনা ও হতাশা যতই থাকুক, আদালত থেকে ফিরে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারুণ্যের যে মহাউত্থান প্রত্যক্ষ করি, তাতে উপলব্ধি করি আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। ব্লগার হিসেবে পরিচিত কয়েকজন তরুণ আমাদের পথের সঠিক নিশানাটি দেখালেন। তারা ফেসবুক, ব্লগ, মোবাইল ফোন ও গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে বার্তা পাঠালেন দিকে দিকে। রক্তের দোলা লাগল ধমনিতে। প্রথমে ১০০, তারপর ১০০০ এবং দিন যেতে না যেতেই কয়েক লাখ। শাহবাগ চত্বর, দ্রুতই যা প্রজন্ম চত্বরে পরিণত হয়ে গেল – সেখানে নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো একাত্তরের রণাঙ্গনের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। আমি অনুভব করলাম, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা করেছে। আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেই একাত্তরের অবিনাশী চেতনাই ফিরে এলো। তরুণদের সাথে যোগ দিল একাত্তরের প্রজন্ম। তাদের হতাশা দূর হয়ে গেল। তরুণরা নতুন নতুন স্লোগান সামনে আনতে থাকল। যাদের কল্পনা, সাহস ও ধীশক্তি আছে তারাই পারে নতুন স্লোগান বাঁধতে এবং তাকে সর্বজনীন রূপ দিতে। আমরা বাংলা হরফের নতুন ব্যবহার দেখতে থাকলাম। সে ব্যবহার দ্রোহের, প্রতিবাদের, প্রত্যয়ের। ‘ক-তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার’, ‘গ-তে গোলাম আযম তুই রাজাকার’। শিশু, যুবা, বৃদ্ধা সবার মুখে একই স্লোগান। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সর্বত্র এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের যেখানে বাঙালি রয়েছে সবাইকে তা স্পর্শ করে গেল, জাগিয়ে তুলতে থাকল। এ মহাজাগরণের আয়োজকরা ৬টি দাবি তুলে ধরলেন। তাতে কেবল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড নয়, আপিলের ক্ষেত্রে গণহত্যাকারী এবং তার শিকার উভয়ের জন্য সমান সুযোগ দাবি করা হলো। আমাদের সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রজন্মের এ আহ্বানে সাড়া দিতে মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না। বিলম্ব করার কথাও নয়। পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তাঁর আজীবন সংগ্রাম ও স্বপ্নের নিবিষ্ট সঙ্গী তিনি। তাঁর মতো আর কে এমন করে নতুন প্রজন্মের ভাব-মানস উপলব্ধী করবে? জাতীয় সংসদে দেওয়া এক আবেগময় ভাষণে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলেন।

বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে মহাজাগরণ ঘটেছে, তার রূপ ভিন্ন। কেউ কেউ শাহবাগ চত্বরকে মিশরের তাহরির স্কোয়ারের সাথে তুলনা করতে চেয়েছেন। কোনো বিচারেই তা ঠিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের কারণে এবং এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রামের পথ বেয়ে বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাহবাগ চত্বরে জাতীয় পুনর্জাগরণের সৃষ্টি করেছে। এ চত্বর একান্তভাবেই বাংলার। এ চত্বর থেকে উত্থিত মহাজাগরণের এমনি সময়ে মানুষ নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে ওঠে। ভেসে যায় পথের সব বাধা। নতুন প্রজন্ম এমনই একটা সময় বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। সাধারণ সময়ে যা অসম্ভব মনে হয়, এখন এই মহাজাগরণের সময়ে সেটাই ঘটেছে স্বতঃস্ফুর্ততায়। তারা দাবি তুলেছে, ‘৭১-এ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে যে জামায়াত ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহ তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তারা যেন কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির মার্জনা না পায়, সেটা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের দাবিও তুলেছে তারা। আমরা বিস্ময়াভিভুত হয়ে দেখলাম, নতুন প্রজন্ম এমন সব কর্মসূচি দিচ্ছে, যার তাৎপর্য গভীর। যেমন, তারা আহ্বান জানালেন নিঃশব্দ মৌনতার। ৩ মিনিট নীরবতার কর্মসূচি সারাদেশে পালিত হলো। তবে এটা তো নীরবতা ছিল না, প্রকৃতপক্ষে শোনা গেল এক সুগভীর গর্জন, যেমনটি উৎসারিত হয় মহাসমুদ্র থেকে।

কবির সুমন গাইলেন,

“তিন মিনিটের জন্য শাহবাগ হলো দেশ।
তিন মিনিটের জন্য দেশটাই শাহবাগ
এ হলো নতুন যুগের জন্ম
আকাশে পূর্বরাগ”

আরেকদিন প্রজ্জ্বলিত হলো মোমবাতি। এক নয়নাভিরাম দৃশ্য রচিত হলো প্রজন্ম চত্বরে, গোটা দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন শহরে। মঙ্গল আলোকে আমরা জেগে উঠলাম, সিক্ত হলাম। ১৭ই ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় একসঙ্গে সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো, গাওয়া হলো জাতীয় সঙ্গীত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডির বাইরেও তাতে মিলল ব্যাপক সাড়া। আর এক দিন আকাশে বেলুন উড়লো ৩০ লক্ষ শহীদদের উদ্দেশ্যে নতুন প্রজন্মের চিঠিসহ। ইতোমধ্যেই শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে ঘোষিত আহ্বান ও কর্মসূচি, জামায়াত-বিএনপির হরতালকে অকার্যকর করে দিচ্ছে, আমাদের নতুন প্রজন্ম সামনে যেসব কর্মসূচি দেবে, তাও যে একই আবেগ ও আন্তরিকতায় পালিত হবে তাতে সন্দেহ নেই।

শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণের ফলে আমাদের তথাকথিত সুশীলদের অনেকেরই মুখোশ খুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম চিনতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত প্রিয় বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কারা। এসময়ে তথাকথিত নিরপেক্ষতার আবরণ দিয়ে অনেকেই আর নিজেদের ঢেকে রাখতে পারছেন না। গণজাগরণে এমনটাই হয়। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে সূচিত গণজাগরণের পর সুশীল সমাজের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে দেখাতে চাচ্ছেন। দু’টি দলের একটিও যুদ্ধাপরাধের সুষ্ঠু বিচার চায় না বলে তারা বলছেন। তারা শাহবাগের গণজাগরণের প্রতি লোকদেখানো সমর্থনও ব্যক্ত করেছেন। তবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে কিছু মৌলিক তথ্য তারা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যান। কারণ সেগুলো প্রচারিত হতে থাকলে তাদের ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক ও অভিন্ন’ তত্ত্ব সুশীল সমাজের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দলকে খুঁজে পাই, যেই দলটি ১৯৭১ সালে সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ব্যাপারে সচেষ্ট থেকেছে বাংলাদেশ জন্মের শুরু থেকেই। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগই Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order 1972′র মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সংগঠিত অপরাধ বিচারের জন্য প্রায় ৩২,০০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছিল। ’৭২ সালের এই দালাল আইনে এদের মধ্যে প্রায় ২০,০০০ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩১শে অক্টোবর নাগাদ ২,৮৪৮টি মামলা সম্পন্ন হয় এবং ৭৫২ জন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও দেয়া হয়। সেই বছরের ৩০শে নভেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে নরহত্যা, নারী ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরকের সাহায্যে ঘরবাড়ি ধ্বংস অথবা জলযান ধ্বংসের অভিযোগে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রযুক্ত হবে না বলে জানানো হয়। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রাখা হয়নি। এমনকি যে আইনের আওতায় আজকে গোলাম আজম সহ অন্যান্য চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হচ্ছে সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল্স আইন ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেন এবং কারাগার থেকে ঐ আইনে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ছেড়ে দেন। আমার মনে আছে ১৪ বছর সাজাপ্রাপ্ত কিশোরগঞ্জের একজন কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডারসহ অনেকই তখন ছাড়া পেয়ে যায়। আমি তখন ঢাকা কারাগারে গোপন বিচার প্রহসনে ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া সবাই ১৯৭৩ সালের আইন প্রয়োগ করে ১৯৭১ সংঘটিত অপরাধের বিচার করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় কে বিচার করতে চেষ্টা করেছে এবং কে বিচার করবার ব্যাপারে নুন্যতম চেষ্টাটুকুও করেনি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করেছে।

শাহবাগের অন্যতম দাবী হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। মানবাধিকার নেতা হিসেবে পরিচিত কেউ বলছেন, এক পক্ষ ফাঁসির দাবী তুলছে এবং অন্যপক্ষ ফাঁসির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে এই বিষয়টি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ – সংসদ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। এই স্তম্ভ তিনটির দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে, অন্য কারো কাছে নয়। বাংলাদেশের মানুষের মনের ইচ্ছা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এই তিনটি স্তম্ভের দায়িত্ব। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের জাতীয় সংসদ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের জেগে উঠা মানুষের মনের ভাষাটি যথার্থ ভাবেই পড়তে পারছে। সংসদ অত্যন্ত দ্রুততায় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল্স) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করেছে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আপিল করবার ব্যাপারে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপক্ষ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সমতা এনে। শাহবাগে সমবেত তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ যখন একই কন্ঠে তাদের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করে না, বরং বাংলাদেশের মানুষের মনের ভাষা পড়বার আহবান জানায় বিচার বিভাগের প্রতি। নিঃসন্দেহে আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। তবে শাহবাগ থেকে ফাঁসির দাবি জানানো যেমন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ঠিক সেভাবেই নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ থেকে উত্থিত জনগণের মনের ভাষা পড়বার দায়িত্ব আমাদের বিচার বিভাগের।

এই আন্দোলন চলাকালেই একাত্তরের ঘাতকদের প্ররোচনা ও নিষ্ঠুরতায় নির্মমভাবে খুন হলেন প্রজন্ম মঞ্চের একজন উদ্দোক্তা রাজীব হায়দার। জামায়াতিদের সোনার বাংলা ব্লগে রাজীবসহ আরও কয়েকজনকে হিটলিস্টে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর পরিণতিতেই প্রজন্ম চত্বর থেকে তিনি ঘরে ফিরতে গিয়ে ফের প্রজন্ম চত্বরে এলেন লাশ হয়ে। তাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। এর কয়েক ঘন্টা আগে ১৫ই ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় মহাসমাবেশ থেকে ডা. ইমরান ঘোষণা দিয়েছিলেন নতুন কর্মসূচি – প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সমাবেশ। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যে কোনো সময়েই লাগাতার অবস্থানের ডাক আসতে পারে এবং সেজন্য যেন সবাই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু এত দ্রুত যে সেটা করতে হবে, তেমন ধারণা করা যায়নি। কাউকে বলে দিতে হলো না। রাজীবের মৃত্যু ফের লাগাতার সমাবেশের সূচনা করল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ আখ্যায়িত করলেন।

নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের সামনে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তারা কোন পক্ষে থাকবেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সিক্ত জাতীয় পুনর্জাগরণের পক্ষে না যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা ধারণ করেন তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা বার বার ফিরে আসুন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

“আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয় তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। [...] প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ”।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের এই অংশগুলোতে রেসকোর্সের লক্ষ লক্ষ জনতাকে ‘আপনি’ নয় বরং ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তা তিনি করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি ৭ কোটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। আজকের দিনের রাজনীতিবিদদেরও জনগণের সাথে সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা মনে করে রাজনীতিবিদরা তাদের একান্ত আপনজন। মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নেতৃত্ব, সততা, সাহস ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা না পাওয়া গেলে তারা নেতৃত্বের জায়গায় থাকবেন না। নেতৃত্ব কারো জন্য বসে থাকবে না। ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে নতুন নেতৃত্ব তার আপন জায়গা করে নেবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম।

তারুণ্যের অভিযাত্রা এগিয়ে চলেছে। কখন তা থামবে, এর শেষ কোথায় এমন সব প্রশ্ন করা হচ্ছে।
কিন্তু আমি বলব, নতুন প্রজন্মের এ জাগরণ চলতে থাকবে। সময়ের প্রয়োজনে ও দাবিতে কেবল রূপ পাল্টাবে। যেমনটি করা হয়েছিল প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৭ ঘন্টার অবস্থান ঘোষণা করে। কখন কী রূপ নেবে এ আন্দোলন সেটা আগেভাগে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা ইতোমধ্যে এ আন্দোলনের সুফল দেখছি। ১৭ই ফেব্রুয়ারি সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন হয়েছে। মহামান্য আদালত নিশ্চয়ই জনতার আদালতের মনোভাব বুঝতে পারবেন। ইতোমধ্যেই এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে আন্তুর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল-১ কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছেন। কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে দেশ। ৪২ বছর পরে হলেও ন্যায় বিচার পেয়েছে দেশবাসী। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্মলাভ করা এই দেশ ন্যায় বিচার করতে পারে। এখানে চাপা দেয়া সত্য প্রকাশিত হয়। আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এখানেই থেমে থাকবে না। কেবল একাত্তরের শীর্ষ যুদ্ধপরাধীরা নয়, সারাদেশে একজন রাজাকার আলবদরও যেন বিচারের আওতার বাইরে না থাকে, সেটা চাইছে নতুন প্রজন্ম।

বাংলাদেশ এখন পুনর্জাগরণের মধ্যে আছে। যাদের কারণে এ নব উত্থান, তাদের মধ্য থেকে শত শত, হাজার হাজার নতুন নেতৃত্ব বের হয়ে আসছে, আরও আসবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পৌঁছার সিংহদ্বার খুলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে সকলের উচ্চারিত দু’টি প্রিয় নামের একটি ‘জয় বাংলা’ নতুন প্রজন্ম ঊচ্চকিত আওয়াজে ব্যবহার করছে নতুন সূচিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনে। অপর প্রিয় শব্দ বঙ্গবন্ধু আছে তাদের হৃদয়ের গভীরে, অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস হয়ে। আর আছে বঙ্গবন্ধুর অমর ৭ই মার্চ ভাষণ। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছি একাত্তরে। আমরা চেয়েছি মানবিক বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। সুন্দর এক সাজানো বাগান চেয়েছি সব নাগরিকের জন্য। এ অর্জনের জন্য নতুন যে জাগরণের প্রয়োজন ছিল, সেটা তরুণরা শুরু করে দিয়েছে এবং লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। তারুণ্যের এই নবজাগরণকে কেউ রুখতে পারবে না। নতুনের জয় অবশ্যম্ভাবী। জয় বাংলা – জয় বঙ্গবন্ধু।

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন: উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।