উড়ার মন্ত্র শেখালেন কালাম

পাঁচ শতাধিক তরুণকে টানা ৪০ মিনিট মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখে ‘স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে সংকটজয়ের মন্ত্র’ শেখালেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম; বললেন- ক্ষুদ্র স্বার্থের পেছনে জীবনকে ছোটানো প্রকারান্তরে অপরাধ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2014, 08:34 PM
Updated : 18 Oct 2014, 01:50 PM

শুক্রবার রাজধানীর একটি হোটেলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতা দেন ৮৩ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী, ভারতের মানুষ যার নাম দিয়েছিল ‘মিসাইল ম্যান’।

তরুণদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কালাম বলেন, সবগুলো স্বপ্ন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মহৎ যত বই আছে সব পড়ে নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান অর্জন চালিয়ে যেতে হবে।

“এবং এই স্বপ্নকে হতে হবে বিশাল। জীবনে ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ একটি অপরাধ।”

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ১১০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনের আমন্ত্রণে ঢাকা সফর করছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি।

তরুণদের সঙ্গে কালামের প্রায় দেড় ঘণ্টার মতবিনিময় চলে আলাপচারিতার ঢঙে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ মিনিট তিনি বক্তব্য দেন, শিক্ষার্থীদের শোনান নিজের জীবনের গল্প, স্বপ্ন আর স্বপ্ন পূরণের আখ্যান।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি।  বারবার তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন- স্বপ্ন  পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যাত্রা থামানো চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে সামনে।

কালাম জানান, ত্রয়োদশ শতকের পারস্যের কবি জালালউদ্দিন রুমির একটি কবিতা তার হৃদয়ে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল। নিজের মতো করে কিছুটা বদলে নিয়ে কবিতাটি তিনি আবৃত্তি করে শোনান, তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে বলেন বাংলাদেশের তরুণদেরও।

“আমি সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছি। আমি জন্মেছি মঙ্গল আর বিশ্বাস নিয়ে। আমি এসেছি স্বপ্ন নিয়ে। মহৎ লক্ষ্য নিয়েই আমার জন্ম। হামাগুড়ির জীবন আমার জন্য নয়, কারণ আমি ডানা নিয়ে এসেছি। আমি উড়ব, উড়ব, আমি উড়বই।

“এই কবিতা আমার জীবন বদলে দিয়েছে,” তুমুল করতালির মধ্যে বলেন কালাম, যাকে দুমুঠো খাবার জোটাতে আট বছর বয়সে সংবাদপত্র বিক্রি করতে হয়েছিল।

১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর একটি ছোট শহরে জন্ম নেওয়া এপিজে আব্দুল কালাম ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারত তাকে সম্মানিত করেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় কাজ করেছেন।

অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করে তিনি ভারতের প্রথম মহাকাশ যান এসএলভি-৩ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন। ওই মহাকাশ যান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ভারতের কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাপনা (স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল সিস্টেমস) এবং ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষায়ও প্রধান ভূমিকা রাখেন এই বিজ্ঞানী, যিনি পরে নিজেকে যুক্ত করেন পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রচারে।

এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পারমাণবিক শক্তি তখন অমঙ্গলের, যখন তা মানব উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্র ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হয়।”

২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে কালাম বলেন, ভারত, পাকিস্তানসহ সব দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার কাজে সামিল হওয়া উচিত।

নিজের লক্ষ্যকে বাস্তব রূপ দিতে কালাম ভারতজুড়ে চষে বেড়িয়েছেন; আইআইটি ও আইআইএম এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন, বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তৃতা করেছেন; সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।

গত দুই দশকে এক কোটি ৮০ লাখ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বলেও জানান তিনি।

কালামের লেখা ২৯টি বইয়ের মধ্যে ‘উইংস অব ফায়ার’ এ ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তার জীবনের ঘটনাক্রম উঠে এসেছে। বইটির ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এ পর্যন্ত।

ওই সাফল্যের অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেন ‘টার্নিং পয়েন্টস’ নামে আরেকটি বই, যাতে নিজের সফলতার পথে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি তুলে এনেছেন।

তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এই বিজ্ঞানী বলেন, জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে যেতে বার বার সমস্যা আসবে, সংকট পথ আটকাবে। কিন্তু হৃদয়ে রাখতে হবে একটি সংকল্প- “আমি সংকটজয়ী হব, সব সমস্যা পেছনে ফেলে ছিনিয়ে নেব সাফল্য।”

উপস্থিত তরুণদের অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফিরে নিজের জীবনের লক্ষ্য নিয়ে এক পৃষ্ঠা লিখে তা ই-মেইল (apj@abdulkalam.com) করতে বলেন কালাম।

জগতের মহান ব্যক্তিত্বদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিতেও তরুণদের উপদেশ দেন তিনি।

“প্রিয় বন্ধুরা, এদিকে তাকাও, কি দেখছ… আলো।  মনে পড়ে আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের কথা, তার বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের কথা।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

“টেলিফোন তোমাদের কার কথা মনে করিয়ে দেয়?... আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল।

“বাংলাদেশের জন্মের কথা বললে তোমাদের কার নাম মনে আসে?... শেখ মুজিবুর রহমান।

“নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- আমাকে মানুষ কেন মনে রাখবে?”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদৃষ্টি থেকে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তেমন স্বপ্ন দেখার, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তরুণদের উৎসাহ দেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি।

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কালাম তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাইকে বলতে বলেন, “...যেখানে হৃদয় হবে ন্যায়-পরায়ণ, চরিত্রে থাকবে সৌন্দর্য, সেই রাজনীতিই আমরা চাই।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত ‘চাকরিপ্রার্থী’ তৈরি না করে ‘চাকরিদাতা’ তৈরি করা।

বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের মতো নাগরিক সুবিধাগুলো গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে পারলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সহজ হয়ে যাবে বলেও মত দেন কালাম।

জীবনের সব পরীক্ষায় সফল এই মানুষটির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিসে তার আনন্দ।

এপিজে কালামের সরল উত্তর, শিক্ষকতা আর গবেষণায়।