পালানোর পথ খুঁজছে আটকা পড়া রোহিঙ্গারা

চলমান সহিংসতার মধ্যে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দুর্গম এলাকায় দুটি রোহিঙ্গা গ্রামে আটকা পড়া কয়েক হাজার মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ চেয়ে আবেদন জানিয়েছে।  

রয়টার্স
Published : 18 Sept 2017, 06:07 AM
Updated : 18 Sept 2017, 11:20 AM

আহ নাউক পিন গ্রামের বাসিন্দা মং মং টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের খাবার ফুরিয়ে এসেছে। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

“আমাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। ওরা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।”

রয়টার্স ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে, যিনি নিজের নাম প্রকাশে রাজি হননি।

তিনি বলেছেন, রাখাইনের বৌদ্ধরা তাদের গ্রামে এসে হুমকি দিয়ে বলে গেছে- ‘পালা, নইলে সবাইকে মারব’।

গত ২৪ অগাস্ট রাতে রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর থেকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এই ভয়ঙ্কর অভিযান চলছে। মুসলমান রোহিঙ্গাদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বিদ্বেষ পেয়েছে নতুন মাত্রা। 

 

অন্তত চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনের এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ বর্ণনা করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানের’ ধ্রপদী উদাহরণ হিসেবে।  

গত মাসের শেষ দিকে নতুন করে এই সহিংসতা শুরুর আগে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস ছিল রাখাইন রাজ্যে। কয়েকশ বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে এলেও সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। এমনকি তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার ওপরও রয়েছে কড়াকড়ি। মিয়ানমারের সংখ্যগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বিবেচনা করে ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। 

রাখাইন রাজ্য সরকারের মুখপাত্র টিন ময় সু রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি রাথেডং এলাকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু কোনো গ্রামের বাসিন্দারা সরে যাওয়ার সুযোগ চেয়েছে বলে তার জানা নেই।

ওই গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ওখানে উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু নেই। দক্ষিণ রাথেডং পুরোপুরি নিরাপদ।”

মিয়ানমার পুলিশের মুখপাত্র মায়ো থু সুও বলেছেন, কোনো রোহিঙ্গা গ্রামের বিষয়ে ওই রকম কোনো তথ্য তার কাছে আসেনি।তবে  বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। 

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্ব এশিয়া ব্যুরোর মুখপাত্র কাতিনা অ্যাডামস বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সহিংসতা বন্ধ করে আইন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে।    

“রাখাইনের উত্তারাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ খাদ্য, পানি আর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে বলে খবর আসছে। মিয়ানমার সরকারের এখনই তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।”

কাতিনা অ্যাডামস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্ব এশিয়া বিভাগের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি প্যাট্রিক মার্ফি এ সপ্তাহেই মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়টি আবারও তুলে ধরবেন।    

এদিকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলার মধ্যেই সোমবার রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করেছে যুক্তরাজ্য।  

পালানোরও পথ নেই

রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের তিনটি শহরের মধ্যে একটি হল রাথেডং। আর রাথেডং উপদ্বীপের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ভেতরে আহ নাউক পিন গ্রামের অবস্থান। গ্রামবাসী বলছে, তাদের কাছে কোনো নৌকা নেই।

তিন সপ্তাহ আগেও মুসলিম অধ্যুষিত ২১টি গ্রাম ছিল রাথেডংয়ে। এছাড়া ছিল রোহিঙ্গাদের তিনটি অস্থায়ী ক্যাম্প, যারা গতবছর অগাস্টের পর সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।

এসব গ্রামের মধ্যে ১৬টি এবং অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো এখন জনশূন্য। অনেক গ্রামেই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনুমানিক ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রাথেডংয়ে এখনও টিকে থাকা পাঁচটি রোহিঙ্গা গ্রাম ঘিরে রেখেছে রাখাইনের বৌদ্ধরা। সেসব গ্রামের আনুমানিক আট হাজার বাসিন্দা খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছে।

এর মধ্যে আহ নাউক পিন এবং কাছের নং পিন গি গ্রামের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ, কারণ সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার পথ খুবই দুর্গম ও কষ্টকর। কোথাও কোথাও ওই পথ আবার রোহিঙ্গাবিরোধীদের দখলে।

আহ নাউক পিন গ্রামের মং মং বলেন, তার এলাকার লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু নিরাপদে চলে যাওয়ার সুযোগ চেয়ে তাদের করা আবেদনে কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি। সারা রাত তারা দূরে গোলাগুলির শব্দ পান।  

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হুমকির মধ্যে থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও রাথেডংয়ের কর্মকর্তা থিয়েন অং বলেছেন, “অন্য কোথাও চলে যাওয়াই তাদের জন্য ভালো।”

গত ২৪ অগাস্ট রাতে যেসব পুলিশ পোস্টে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলা হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি ছিল রাথেডংয়ে। এই শহরকে এখন গ্রাস করে নিয়েছে ধর্মীয় উত্তেজনা।

জুলাইয়ের শেষ দিকে এই রাথেডংয়েই রোহিঙ্গাদের এক গ্রাম ঘিরে ফেলে খাবার ও পানি নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় রাখাইনের বৌদ্ধরা। আরসার সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের হুমকির কথা বলে রাথেডংয়ের দক্ষিণের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতেও একই ঘটনা চলছে। 

‘অন্য কোথাও’

মং মং বলেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পরিচিত এক বৌদ্ধের কাছ থেকে ফোন পান। ওই ব্যক্তি হুমকি দেন, গ্রাম ছেড়ে না পালালে সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে।   

টেলিফোনে সেই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড মং মং রয়টার্সকে দিয়েছেন।

হুমকি পেয়ে মং মং বলেছিলেন, তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। জবাবে ওই হুমকিদাতা বলেন, এটা তাদের সমস্যা নয়।

গ্রামের মানুষের এই বিপদের কথা জানিয়ে পুলিশকে অন্তত ৩০ বার ফোন করেছেন বলে জানান মং মং।

গত ৩১ অগাস্ট আহ নাউক পিন গ্রামের সাতজন রোহিঙ্গা এবং পাশের গ্রামের ১৪ জন বৌদ্ধকে নিয়ে রাস্তার ধারে একটি বৈঠক করে পুলিশ। সেখানে রোহিঙ্গাদের কোনো অভিযোগ না শুনে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে আল্টিমেটাম দেওয়া হয় বলে জানান মং মং এবং বৈঠকে উপস্থিত আরও দুই রোহিঙ্গা।

তাদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা বলেন, “তারা বৈঠকে জানিয়ে দেয়, এই এলাকায় কোনো মুসলমানকে তারা রাখতে চায় না। সুতরাং মুসলমানদের অবিলম্বে চলে যেতে হবে।”

মং মং বলেন, রোহিঙ্গারা চলে যেতেও রাজি। কিন্তু তারা চায়, চলে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ যেন অন্তত নিরাপত্তা দেয়।

এ গ্রামের রোহিঙ্গা মুসলমানদের অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নিতে গ্রামের মুরুব্বিরা গত ৭ সেপ্টেম্বর রাথেডাং কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি দেন। কিন্তু তার কোনো জবাব এখনও মেলেনি বলে জানান মং মং।