তিন পক্ষই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘হুমকি’ হিসেবে দেখছে। রাখাইন রাজ্যের মুসলমান ওই জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর যে অভিযান চলছে, তাতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে অন্যরা।
দীর্ঘ সেনাশাসনের দিনগুলোতে সু চির দলকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অন্য অনেকের মত এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতা নিয়ান উইনকেও বছর তিনেক জেলে কাটাতে হয়েছে সে সময়।
সেই নিয়ান উইন বলছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব তারা কোনোভাবেই লংঘিত হতে দিতে পারেন না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই জায়গাতেই তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে একজোট।
“আমরা সেনাবাহিনীকে পছন্দ করি না। কিন্তু এই বিষয়ে আমরা এক।
তিনি বলেন, “এরা (রোহিঙ্গা) অবৈধ অভিবাসী, এটা নিশ্চিত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনও সেটা বলে না।”
জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের গ্রামে সেনা অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূলের’ চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করলেও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিরা বলছেন, সু চির পক্ষ ত্যাগ করে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপের রাস্তায় গেলে দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার প্রক্রিয়া ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, চলাচলের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
গত ২৪ অগাস্ট রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর থেকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানে সরকারি ভাষ্যেই চারশর বেশি নিহত হয়েছে; ধ্বংস হয়েছে ছয় হাজার ৮০০ বাড়ি-ঘর।
এই দমন-পীড়নের মুখে চার লাখের মত রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা দশ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে।
বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করায় সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সু চি। তবে নতুন সৃষ্ট ‘স্টেট কাউন্সেলর’ পদের অধিকারী হিসেবে কার্যত তিনিই সরকার চালাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যাই আসুক, সু চির ভাষ্য হল- রাখাইনে বেসামরিকদের হত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) দায়ী। রাখাইন অভিযান নিয়ে ‘বড় পরিসরে ভুয়া তথ্য’ প্রচার করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
সেনা শাসকদের হাতে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দিত্বে কাটানো সু চি পরিণত হয়েছিলেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আইকনে; ছিলেন সবার কাছে সম্মানের আসনে। গণতন্ত্রের পক্ষে অহিংস আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
কিন্তু রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে বর্তমান অবস্থানের কারণে এখন তিনি অনেক নোবেলবিজয়ী এবং বিশ্ব নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এমনকি তার নোবেল কেড়ে নেওয়ার দাবিও উঠেছে।
রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্যাতন চলছে, তার নিন্দা জানানোর জন্য সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই।
তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি নীরবতা ভাঙবেন- পুরো বিশ্ব সেই অপেক্ষায় আছে।
মালালার ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নান উইন্ট নামে মিয়ানমারের এক নাগরিক টুইটে লিখেছেন, “তোমার প্রতি ধিক্কার মালালা! আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। কোনো রোহিঙ্গা নেই, রাখাইনে শুধু বাঙালি সন্ত্রাসী আছে।”
চলমান সেনা অভিযানের পক্ষে জনসমর্থন বাড়াতে বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছে সু চির সরকার। অনেক ফেইসবুক ও টুইটার পোস্টে সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত অমুসলিমদের প্রতি সমর্থন দেখানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবাধিকার লংঘনের ‘ভুয়া খবর’ প্রচারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
অং শিন নামে এনএলডির একজন মুখপাত্র বলেন, “বিদেশিরা রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করছেন, তা তৈরি হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্যের ভিত্তিতে। রাখাইনের আসল পরিস্থিতি কেবল মিয়ানমারের নাগরিকরাই বুঝতে পারছে।”
মিয়ানমারের অনেকেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য হুমকি বলে মনে করেন।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, গত তিন সপ্তাহের সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ১৬ জন অমুসলিমও রয়েছেন। পাশাপাশি প্রায় ৩০ হাজার অমুসলিম ঘর-বাড়ি ছেড়ে বড় শহরগুলোতে পালিয়েছেন।
‘সত্যিকারের অভিভাবক’
রাখাইনের এই সংঘাত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো মিয়ানমারজুড়ে।
গত রোববার সন্ধ্যায় মিয়ানমারের মাগওয়ে এলাকার একটি শহরে লাঠি ও তরবারি হাতে একদল লোক একটি মসজিদে হামলা চালাতে যায়। পরে রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। অন্যান্য মসজিদেও হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানিয়েছেন মুসলমানরা।
“এখানকার সবাই মনে করছে, তাদের ভুল বোঝা হচ্ছে। তারা ভাবছে, ‘বিশ্বে যে ধারণা আমাদের সম্পর্কে দেওয়া হচ্ছে, তেমন খারাপ মানুষ আমরা নই। আমরা না, বরং তারাই আমাদের হত্যা করছে। আপনারা এটা নিয়ে কথা বলছেন না কেন’?”
কূটনীতিকরা বলছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সু চিকে রাজনৈতিকভাবে একটি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছে বলে তাদের মনে হচ্ছে। ২০১১ সালে দেশটিতে বেসামরিকীকরণ শুরু হলেও এখনও রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষমতা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
সেনাবাহিনী নিজেদের মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রকৃত অভিভাবক হিসেবে চিত্রায়িত করে। আর এটাই সু চির নীরবতার কারণ হতে পারে বলে কূটনীতিকদের অভিমত।
এনএলডি নেতা নিয়ান উইন বলেন, “তিনি (সু চি) যদি এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। তাতে রাখাইন সংকটের সমাধান আরও কঠিন হয়ে যাবে।”
রাখাইনে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা তাদের মানুষ হিসেবে মেনে নিতে পারি, কিন্তু তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিতে পারি না, কারণ তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।”
“আমরা তাদের মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে দিতে পারি না, কারণ তারা আমাদের নাগরিক নয়।”