বিচারকের মানসিক সুস্থতা: নজিরবিহীন সঙ্কটে ভারত

ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এক বিচারকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর নজিরবিহীন জটিলতায় জড়িয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই গণতান্ত্রিক দেশের বিচার বিভাগ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2017, 06:27 AM
Updated : 3 May 2017, 06:37 AM

সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে গত সাত মাস ধরে চলা দ্বন্দ্বের মধ্যেই বুধবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনান দেশের প্রধান বিচারপতিসহ সর্বোচ্চ আদালতের সাত বিচারকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন।  

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত এক আদালত অবমাননার মামলায় সম্প্রতি বিচারপতি কারনানের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়।

এরপর কথার লড়াইয়ের মধ্যে ভারতের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহারের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ গত সোমবার বিচারপতি কারনানের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে।

ওই আদেশে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশকে বলা হয়, কলকাতার কোনো সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ড করে বিচারপতি কারনানের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে সেই প্রতিবেদন দিতে হবে ৮ মের মধ্যে। 

ক্ষিপ্ত বিচারপতি কারনান এরপর নিজের বাসায় বিশেষ আদালত বসিয়ে পাল্টা আদেশ জারি করেন। সেখানে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ ওই নির্দেশ দিয়েছিল, তাদের সবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।

এরপর বুধবার নতুন আদেশে তিনি প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারককে গ্রেপ্তারে জামিন অযোগ্য পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন। 

অবশ্য এই দ্বন্দ্বের মধ্যে বিচারপতি কারনানের বিচারিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা আগেই কেড়ে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে তার ওই নির্দেশের কোনো আইনি বৈধতা নেই বলে মনে করছেন ভারতের আইন বিশেষজ্ঞরা।

যেভাবে সূচনা

আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কখনও মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, কখনও বিচারপতি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে, কখনও বা সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিজের বদলির নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি আগেও বহুবার আলোচনায় এসেছেন বিচারপতি কারনান।

তার এক চিঠির সূত্র ধরে গত ২৩ জানুয়ারি ভারতীয় বিচারাঙ্গনে দ্বন্দ্ব বর্তমান চেহারা পেতে শুরু করে।

ভারতের ২০ জন বিচারক ও তিনজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ওই চিঠি লেখেন তিনি। অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দিতে না পারলেও ওই চিঠিতে তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়।

এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে বিচারপতি কারনানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করে।

সেখানে বলা হয়, বিচারপতি কারনান এর আগেও একইভাবে তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছিলেন। তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কেন আদালত অবমাননা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না- সেই ব্যাখ্যা তাকে দিতে হবে।

সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখ ঠিক করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু বিচারপতি কারনান সেদিন হাজির না হলে তাকে আরও একবার সুযোগ দিয়ে ১০ মার্চ নতুন তারিখ রাখা হয়।

বিচারপতি কারনান ওই আদেশও উপেক্ষা করলে সুপ্রিম কোর্ট তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে এবং ৩১ মার্চ তাকে আদালতে হাজির করতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে নির্দেশ দেয়।

তখনই তার বিচার ও দাপ্তরিক কাজে অংশগ্রহণের ওপর অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সুপ্রিম কোর্ট। তবে বিদ্রোহী এই বিচারক তাতে দমে যাননি মোটেও।

নতুন মাত্রা

সুপ্রিম কোর্টের সমন জারির দিনই সঙ্কট নতুন মাত্রা পায়। দলিত সম্প্রদায় থেকে আসা বিচারপতি কারনান সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন। তার অভিযোগ, দলিত বলেই উচ্চবর্ণের বিচারপতিরা তাকে হেনস্তা করছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা নিবন্ধনের নির্দেশ দেন বিচারপতি কারনান। বলা হয়, ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে ১৪ কোটি রুপি দিতে হবে ওই বিচারকদের।

কয়েকদিন পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলে বিচারপতি কারনান সুপ্রিম কোর্টের ওই পরোয়ানাকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করেন। এরপর পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে।     

বিচারপতি কারনান গত শুক্রবার নিজের বাসায় এজলাস বসিয়ে ভারতবাসীকে হতবাক করে দিয়ে এক আদেশ জারি করেন। ভারতের প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের ওই সাত বিচারকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় ওই আদেশে।

ভারতের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে ওই আদেশে বলা হয়, যেহেতু ওই সাত বিচারকের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্যের মামলা রয়েছে, সেহেতু আপাতত তাদের দেশের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না।

সেইসঙ্গে দেশের শীর্ষ সাত বিচারককে ১ মে নিজের বাড়ির এজলাসে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করেন কলকাতা হাই কোর্টের এই বিচারক। ওই একই দিনে বিচারপতি কারনানকে সুপ্রিম কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত।

প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চের আদেশে সোমবার বলা হয়, বিচারপতি কারনান যেভাবে সর্বোচ্চ আদালতের সাত বিচারককে কলকাতায় তলব করেছেন এবং সেই বিবৃতি যেভাবে সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে আদালতের মনে হয়েছে, তিনি হয়ত আদালত অবমাননার মামলায় নিজের পক্ষে ঠিকমত সওয়াল-জবাবে অংশ নিতে পারবেন না।

এ কারণেই বিচারপতি কারনানের মানসিক সুস্থতা খতিয়ে দেখে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর পাল্টায় ওইদিন আরেক আদেশে বিচারপতি কারনান বলেন, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং তার স্ত্রী ও দুই ছেলে এ বিষয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট। 

সুপ্রিম কোর্টের ওই আদেশকে দলিত সম্প্রদায়ের একজন বিচারকের প্রতি ‘অপমান’ হিসেবে বর্ণনা করে বিচারপতি কারনান সাফ জানিয়ে দেন, কোনো ধরনের মেডিকেল পরীক্ষা তিনি করাতে দেবেন না।

কয়েক ঘণ্টা পর তিনি পাল্টা আদেশ জারি করেন। সেখানে দিল্লি পুলিশের মহাপরিচালককে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারকের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ৭ মে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।  

বিচারপতি কারনানের আইনজীবি পিটার রমেশ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার যে মামলা চলছে, সেখানে মেডিকেল পরীক্ষার মত আদেশ দেওয়ার সুযোগ নেই। ওই পরীক্ষা করাতে হলে ২০১৭ সালের মানসিক ব্যাধি আইনে তা করতে হবে।

“বিচারপতি কারনান মনে করছেন, সর্বোচ্চ আদালতের যে মাননীয় বিচারকরা এই নির্দেশ দিয়েছেন, তাদেরই পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে - কারণ তারা বিচারপতি কারনানের মতো একজন সুস্থ মস্তিষ্কের বিচারকের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছেন।”

এদিকে বিচারপতি কারনান তার তলবে হাজির না হওয়ায় বুধবার প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন বলে এনডিটিভির খবর। 

ওই আদেশে বলা হয়, জনস্বার্থে দুর্নীতি ও অস্থিরতা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য বিচারপতি কারনান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই নির্দেশ দিয়েছেন। 

সমাধান কী?

বিবিসি লিখেছে, ভারতের বিচারাঙ্গনের ইতিহাসে এমন ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি। ফলে কেউ বলতে পারছেন না, এরপর কী ঘটতে পারে। 

বৃহস্পতিবার বিচারপতি কারনানের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে দেওয়ার তারিখ রয়েছে। তবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে পরীক্ষায় বাধ্য করা যাবে বলে মনে করছেন না কেউ।

ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যকে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা লিখেছে, “এরকম ঘটনা আগে হয়নি। তবে আমার মনে হয়, সুপ্রিম কোর্ট বোধহয় একটু ভুল করে ফেলছে। বিচারপতি কারনানের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকত, তাহলে তাদের নিজস্ব বিবাদ মেটানোর যে ব্যবস্থাপনা আছে, তা দিয়েই করা যেত। আদালত অবমাননার মামলা হল কেন?"

এই আইনজীবীর যুক্তি, বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করে সেই প্রতিবেদন যদি প্রকাশ করা হত, তাতে যদি দেখা যেত যে বিচারপতি কারনানের অভিযোগ ভিত্তিহীন, তাহলেই পরিস্থিতি আর এতটা ঘোলা হত না।

ভারতের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টানাপড়েন চলতে পারে অন্তত আগামী ১২ জুন পর্যন্ত। ওইদিন বিচারপতি কারনানের বয়স ৬২ বছর হবে এবং তিনি অবসরে যাবেন। 

আইন অনুযায়ী, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সুপ্রিম কোর্টের জন্যও সহজ হবে।