মিয়ানমারে ‘যেভাবে’ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান

মিয়ানমারে কয়েক দশকের জাতিগত নিপীড়নের ইতিহাসে ‘প্রথমবারের মতো’ রোহিঙ্গাদের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যা ক্রমেই পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিদের দৃষ্টি কাড়ছে বলে খবর দিয়েছে রয়টার্স।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2017, 06:26 PM
Updated : 10 March 2017, 06:34 PM

এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থাটি বলেছে, হারাকাহ আল ইয়াকিন (বিশ্বাসের লড়াই) নামে নতুন এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীই ছয় মাস আগে রাখাইন রাজ্যে সংঘাত উসকে দেয়।

এই গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরকেও ব্যবহার করছে এবং শরণার্থীদের কয়েকজন এপার থেকে অস্ত্র চুরি করে ওপারে দিয়ে গত অক্টোবরের হামলায় অংশ নেয় বলে পর্যবেক্ষক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে রয়টার্স।

অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনের অধীনে থাকা মিয়ানমারের গণতন্ত্রে রূপান্তরের পথে ‘বিদ্রোহীদের এ উত্থানকে’ সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এগারো লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত বৌদ্ধ প্রধান রাখাইন রাজ্যে জাতিগত উত্তেজনা বহু দিনের ।এই রাজ্যে ২০১২ সালে ভয়াবহ সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকেরর পর সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা রাজ্যের ভেতরে বিদ্রোহী তৎপরতার প্রথম নিদর্শন।

সংঘাতপূর্ণ ওই এলাকার গ্রামগুলোর বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা, আটক কয়েকজন বিদ্রোহীকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলেছে রয়টার্স।

সেসব তথ্যের সত্যতা নিরপক্ষেভাবে যাচাই করা সম্ভব না হলেও ওই গোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের সংগঠিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তার উপর নতুন করে আলোকপাত করা সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, কীভাবে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজনসহ ওই গোষ্ঠীর নেতাদের ছোট একটি দল কয়েকশ তরুণকে জড়ো করে কয়েকমাস ধরে বনে-জঙ্গলে গোপনে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

সেসব প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন ইয়ে খাত চুয়াং গ সন গ্রামের ২৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ শাহ। তাকে ওই গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া ডাক না দেওয়া হলেও গত অক্টোবরে তাদের প্রথম হামলা পরিচালনার আগে প্রায় ছয় মাস ধরে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অবগত বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

একবার তিনি তার গ্রামের পাশে একটি বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৩০ জনকে কাঠের তৈরি নকল অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে দেখেন।

তিনি বলেন, “আমি তাদের বাহবা দিয়েছি। কারণ কয়েক দশক ধরে আমাদের নির্মূল করা হচ্ছে। আর তারা ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।”

প্রতিবেদনে রয়টার্স বলেছে, গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে বিভিন্ন পুলিশ পোস্টে তিনটি সমন্বিত হামলা চালিয়ে নয় কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনার পর অনলাইনে ভিডিও পোস্ট করে দায় স্বীকার করে হারাকাহ আল ইয়াকিন (হা-য়ি) নামের এই গোষ্ঠী।

উত্তর রাখাইনের অধিবাসী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা রয়টার্সকে বলেছেন, হা-য়ি বাংলাদেশে সীমান্তজুড়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং এ গোষ্ঠীর নেতাদের কারো কারো সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ রয়েছে।

উ শে কিয়া গ্রামের অন্তত তিন অধিবাসী রয়টার্সকে বলেছেন, এই গোষ্ঠী ২০১৬ সালের শুরুর দিকে বয়স্কদের দলে যোগ দেওয়ার ডাক দিলে কেউ কেউ প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায়।

একজন বলেন, “প্রথমে গ্রামের কয়েকজনকে তারা দলে ভেড়ায়, তারপর তারা একে একে অন্যদের উৎসাহিত করতে থাকে।

“তারা দোকানের সামনে, চায়ের স্টলে গিয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতো।”

গত বছরের ওই তিন হামলার ঘটনায় নূর মোহাম্মদ নামে হা-য়ির এক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গত মাসে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা এধরনের হামলার ঘটনায় প্রথম রায়।

রাজ্যের রাজধানী সিত্তের কারাগারে সন্দেহভাজন হামলাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ ক্যাপ্টেন ইয়াং নাইং লাট রয়টার্সকে বলেন, ওই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল রাখাইনের উত্তর অংশ দখল করে ‘রোহিঙ্গাদের জন্য মুসলিম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা’।

“সব মিলে তাদের ছয়টি সেল (ছোট দল) ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে তিনটি দল হামলা পরিচালনায় সফল হয়। মোহাম্মদ নূরের মতো নেতারা অস্ত্র নিয়ে গ্রামে গিয়ে লোক জড়ো করে কারাতে ও গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ দেয়।”

ওই পুলিশ কর্মকর্তার মতে, হামলাকারীদের কেউ কেউ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এসেছে। তারা অস্ত্র চুরি করে এনে ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দেয়।

গত ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ও সৌদি আরবে বড় হওয়া আতা উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাকে হা-য়ির নেতা হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

অনলাইনে ওই গ্রুপের পোস্ট করা এক ভিডিওতে তাকে কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জিহাদের ডাক দিতে দেখা যায়। রোহিঙ্গা গ্রামবাসী যারা ওই ভিডিও দেখেছেন, তারা বলেছেন, লোক জড়ো করা ও প্রশিক্ষণদাতা ওই গোষ্ঠীর নেতাদের মধ্যে তাকে দেখেছেন তারা।

রোহিঙ্গারা বলছেন, ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সৃষ্ট হতাশা থেকে মুসলমানদের মধ্যে সমর্থন পাচ্ছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

মিয়ানমার সরকার মনে করছে, আতা উল্লাহ ও আরেক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সদস্য পাকিস্তানে তালেবান প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সমর্থন দিয়ে আসছে।

মিয়ানমারের একজন জ্যেষ্ঠ সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই গোষ্ঠী ২০১৩ সাল থেকে বিদ্রোহের চেষ্টা করে এলেও ২০১৫ সালের আগে জমিন তৈরি করতে পারেনি। শেষ দিকে তারা কিছু তহবিল পায়।

সীমান্তজুড়ে চলাচলকারী মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “তারা (হা-য়ি নেতারা) তরুণ শিক্ষিত মুসলমানদের টার্গেট করে । তাদের নিয়ে বাংলাদেশে কয়েকটি বৈঠকও করেছে।”

ফেব্রুয়ারিতে অনলাইনে প্রচারিত এক ভিডিওতে তলোয়ার ও লাঠি হাতে মুখোশ পরা একদল তরুণকে দেখা যায়, যারা নিজেদের হারাকাহ আল ইয়াকিনের সদস্য বলে দাবি করে।

রয়টার্স বলেছে, তারা ওই ক্লিপের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।