তামিলনাড়ুর ‘আম্মা’ জয়ললিতা আর নেই

রাজ‌্যের গণ্ডির মধ‌্যে থেকেই যারা ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির কলকাঠি নাড়তে সক্ষম ছিলেন, তাদের একজন জয়ললিতা জয়রাম মারা গেছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2016, 07:04 PM
Updated : 10 Dec 2016, 03:14 AM

সোমবার গভীর রাতে তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ের অ‌্যাপোলো হাসপাতালে তার মৃত‌্যু হয় বলে এনডিটিভি, টাইমস অফ ইন্ডিয়াসহ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ‌্যমে খবর এসেছে।

গত তিন মাস ধরে এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন রাজ‌্যটির মুখ‌্যমন্ত্রী জয়ললিতা। এর মধ‌্যে সোমবার সন্ধ‌্যায় তার অবস্থার অবনতি ঘটলে কয়েকটি টেলিভিশনে তার মৃত‌্যুর খবরও প্রচার হয়ে গিয়েছিল।

এরপর জয়ললিতার দল অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাঘম (এআইএডিএমকে) এর দপ্তরে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতও করে ফেলা হয়েছিল।

কিন্তু পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে জানায়, ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন ৬৮ বছর বয়সী এই রাজনীতিক। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

অভিনেত্রী থেকে জননেত্রীতে পরিণত হওয়া জয়ললিতার জন‌্য প্রার্থনা করছিলেন তামিলনাড়ুবাসী, যাদের কাছে তিনি ‘আম্মা’ হিসেবেই পরিচিত। 

কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডুও হাসপাতালে জয়ললিতাকে দেখে এসে তার সার্বিক অবস্থা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জানান।

দেশটির অন‌্য রাজ‌্যসহ কেন্দ্রীয় রাজনীতিকরাও তামিলনাড়ুর পাঁচ বারের মুখ‌্যমন্ত্রীর আরোগ‌্য কামনা করছিলেন; যদিও চিকিৎসকদের কথায় খুব একটা ভরসা মিলছিল না।

এরপর গভীর রাতে অ‌্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মুখ‌্যমন্ত্রীর মৃত‌্যু ঘোষণা করেন।

তারপর এআইডিএমকে এক টুইটে বলে, “আমাদের প্রিয় নেতা, আয়রন লেডি.. আমাদের আম্মা আর নেই।”

গত ২২ সেপ্টেম্বর জয়ললিতা হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রথমে জানানো হয়েছিল, তার জ্বর ও পানিশূন‌্যতা হয়েছে। পরে চিকিৎসকরা তার ফুসফুসে সংক্রমণ ও শ্বাস নিতে সমস‌্যা হওয়ার কথা জানান।

এর কয়েক সপ্তাহ পর তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির কথা জানানো হয়। গত শনিবারও এআইডিএমকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মুখ‌্যমন্ত্রী পুরোপুরি সেরে উঠেছেন। এখন চিকিৎসকরা বলবেন, কখন তিনি ঘরে ফিরবেন।

তার দুদিনের মাথায় তার ‘কার্ডিয়াক অ‌্যারেস্ট’ হলে মৃত‌্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

তার পরিপ্রেক্ষিতে অ‌্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্ধ‌্যায় একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, মুখ‌্যমন্ত্রী ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন, চিকিৎকসরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তাকে।

অ‌্যাপোলো হাসপাতালের সঙ্গে নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের একদল চিকিৎসকও প্রভাবশালী এই রাজনীতিকের চিকিৎসায় যোগ দিয়েছেন।

“তার শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক। তবে আমরা নিশ্চিত করছি, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টার সবটুকু করছি আমরা,” সাংবাদিকদের বলেছিলেন ওই হাসপাতালের ব্রিটিশ চিকিৎসক রিচার্ড বেলে।

হাসপাতালটির বাইরে ইতোমধ‌্যে জয়ললিতার সমর্থকরা ভিড় করেছেন। মৃত‌্যুর গুঞ্জনের পর তাদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষের খবরও দিয়েছে সংবাদ মাধ‌্যম।

জয়ললিতার ছবি হাতে তার সমর্থকরা- ছবি: রয়টার্স

তার মৃত‌্যুর পর চেন্নাই শহর থমকে পড়েছে। সেখানে এক রকম হরতালের অবস্থা বিরাজ করছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন। 

নেত্রীর অসুস্থতার খবরে লোকসভায় এআইডিএমকের ৩৭ সদস্যের অধিকাংশই নয়া দিল্লি থেকে চেন্নাইয়ে হাজির হয়েছিলেন।

৫৪৫ আসনের লোকসভায় তামিলনাড়ুর এই আঞ্চলিক দলটির আসন সংখ‌্যা এত কম হলেও গত দুই দশক ধরে কেন্দ্রে সরকার গঠনে নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করছেন জয়ললিতা।

ভারতের রাজনীতিতে অন‌্যতম শক্তিশালী নারী হিসেবেও পরিচিত জয়ললিতা। গত শতকের ৮০ এর দশকে রাজনীতিতে পা রাখার পর নানা উত্থান-পতন আর আলোচনা-সমালোচনার মধ‌্য দিয়ে চলছিলেন তিনি।

একবার মুখ‌্যমন্ত্রিত্ব করার পরের বার গো-হারা হেরে যাওয়ার পরও তা থেকেই পুনরায় উঠে আসার নজির রেখেছেন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে গেলেও লড়াই ছাড়েননি তিনি।

কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে, কখনও বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে, কখনওবা তৃতীয় মোর্চা গড়ে দিল্লির মসনদধারী নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে দেখা গিয়েছিল তাকে।

অভিনেতা থেকে ভারতের সমৃদ্ধ রাজ‌্য তামিলনাড়ুর মুখ‌্যমন্ত্রী হওয়া এম জি রামাচন্দ্রনের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন শতাধিক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী জয়ললিতা।

জয়ললিতা, তখন অভিনেত্রী থেকে সবে রাজনীতিতে

তার পর তাকে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। ১৯৮৭ সালে রামাচন্দ্রন মারা যাওয়ার পর দলের কর্তৃত্ব নেন তিনি। তবে বাধা আসে রামাচন্দ্রনের স্ত্রী জানকি রামাচন্দ্রনের কাছ থেকে। তবে শেষমেষ জয় জয়ললিতারই হয়, দলের প্রতীক ‘জোড়া পাতা’ দখলে রাখতে পারেন তিনি।

এরপর নির্বাচনে নামিলনাড়ুর রাজ‌্য বিধান সভায় প্রথম নারী হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন জয়ললিতা।

তখন ১৯৮৯ সালে একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা তাকে মুখ‌্যমন্ত্রী হতে অনমনীয় করে তোলে বলে বিশ্লেষকরা বলেন।

ওই বছরের ২৫ মার্চ বিধান সভায় ক্ষমতাসীন ডিএমকে এবং বিরোধী এআইডিএমকের সদস‌্যদের মধ‌্যে তুমুল হট্টগোল হয়, তখন হেনস্তার স্বীকার হন বিরোধীদলীয় নেতা জয়ললিতা।

ছেড়া শাড়ি, উশকোখুশকো চুল আর রক্তাভ মুখ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে তিনি তখন বলেছিলেন, মুখ‌্যমন্ত্রী হয়ে না আসতে পারলে তিনি আর বিধান সভায়ই ঢুকবেন না।

তার দুই বছরের মধ‌্যে প্রথম মুখ‌্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা এবং সেটাই শেষ নয়, এরপর একাধিকবার শপথ নিয়ে এই চেয়ারে ছিলেন তিনি।