পাকিস্তানের দক্ষিণ পাঞ্জাব: জঙ্গিবাদের ‘চারণভূমি’

দক্ষিণ এশিয়ায় যদি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই চালাতে হয়, তাহলে মূল নজর দিতে হবে পাকিস্তানের দক্ষিণ পাঞ্জাবের দিকে- এই পর্যবেক্ষণ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2016, 02:54 PM
Updated : 30 May 2016, 02:54 PM

বিশ্বজুড়ে সহিংস সংঘাতের পূর্বাপর নিয়ে গবেষণা এবং তা থেকে উত্তরণে পরামর্শ দেওয়া ব্রাসেলসভিত্তিক বেসরকারি সংস্থাটি সোমবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

তাদের বিশ্লেষণে পাকিস্তানের দক্ষিণ পাঞ্জাবে জঙ্গিদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ, তাদের প্রতি দেশটির সরকারের নমনীয় নীতি, তাদের সদস্য সংগ্রহে বিদেশি মদদ সবকিছুই উঠে এসেছে।

দক্ষিণ পাঞ্জাবের ভৌগলিক অবস্থানই একে জঙ্গিবাদীদের কিংবা জিহাদিদের চারণভূমি হিসেবে গড়ে তুলেছে বলে মনে করছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

পাকিস্তানের এই প্রদেশটির এক পাশের সীমান্তজুড়ে ভারতের সীমানা, এক পাশে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মির এবং অন্য পাশে রয়েছে তালেবান হামলায় বিক্ষত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।

পাকিস্তানের মানচিত্র পাঞ্জাব

অবস্থানগত এবং সরকারের নমনীয়তার এই সুবিধা নিয়ে মানুষের মধ্যে জইশ-ই মোহাম্মদ ও লস্কর-ই জাংভির মতো সংগঠনগুলো জেঁকে বসেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এতে বলা হয়েছে, এই দক্ষিণ পাঞ্জাবেই মাদ্রাসা ‍ও মসজিদভিত্তিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা চলে।

জইশ-ই মোহাম্মদের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশি জঙ্গিদের যোগাযোগের বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। তাদের মতো আরেকটি দল লস্কর-ই তৈয়বার কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তারও হন বাংলাদেশে।  

পাকিস্তানি জিহাদি এই দলগুলোর তৎপরতার ভারতেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। নয়া দিল্লি অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইসলামাবাদ এদের মদদ দিচ্ছে।  

এই বছরের জানুয়ারিতে ভারতের পাঠানকোটে বিমান ঘাঁটিতে হামলার জন্য জইশ-ই মোহাম্মদ দলটিকে দায়ী করা হয়। অন্যদিকে মার্চে লাহোরে বোমাহামলা চালিয়ে ৭০ জনকে হত্যার জন্য দায়ী করা হয় নিষিদ্ধ দল লস্কর-ই জাংভিকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গি তৎপরতা যদি কমিয়ে আনতে হয় তাহলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও পাঞ্জাবের প্রাদেশিক উভয় সরকারকে এই দল দুটির অবাধ বিচরণের বর্তমান পরিবেশ বদলাতে হবে।

পাঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমাজ কিন্তু এরকম ছিল না। গত কয়েক দশক ধরে সেখানে চরমপন্থিদের দৌরাত্ম্য চলছে।

জইশ-ই মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পাকিস্তানেই

এজন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের তরফে ছায়া দিয়ে যাওয়া, বিদেশ থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে তহবিল জোগানো, রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতাকে দায়ী করেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

আইনের শাসনের অনুপস্থিতিও জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে তাদের মূল দক্ষিণ পাঞ্জাবের সমাজে প্রোথিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পাঞ্জাব পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ হলেও এরই দক্ষিণাংশ সবচেয়ে গরিব এলাকা। বন্যা আর খরা- দুই ধরনের দুর্যোগের ধকলই পোহাতে হয় এই গরিব মানুষদের।

আর্থিক টানাপড়েনে থাকা এই অঞ্চলের মানুষগুলোকে নানা প্রলোভনে সহজেই উগ্রবাদীরা হাত করে নেয় বলে ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়।

এতে বলা হয়, অনুকূল অবস্থার সুযোগ নিয়ে জিহাদি সংগঠনগুলো দক্ষিণ পাঞ্জাবে তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছে।

পাকিস্তানের এই অঞ্চলে বহু দেওবন্দ মাদ্রাসা রয়েছে, সেখানে এবং মসজিদগুলোতে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে মানুষকে জঙ্গিবাদী করে তোলা হয় বলে ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণ। 

দীর্ঘকাল মদদ দিয়ে এলেও ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পেশোয়ারে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্কুলে তালেবান হামলায় ১৫০ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের জঙ্গিদের উপর খড়গহস্ত হয়।

তবে ওই ঘটনার পর পাকিস্তান সরকারের নেওয়া ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (এনএপি) সেভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

এক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের ‘ভালো জিহাদি (যাদের ভারত বা আফগানিস্তান বিষয়ে কৌশলগতভাবে কাজে লাগানো যায়) আর ‘মন্দ জিহাদি (যারা দেশের মধ্যে হামলা চালায়)’ খোঁজার দুর্বলতার কথা বলেছে সংস্থাটি।

পাঞ্জাবে প্রকাশ্যে সমাবেশে লস্কর-ই জাংভি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেশোয়ারের ঘটনার পর জঙ্গি সংগঠনগুলো দমনে উপর সরকার ও সেনাবাহিনী অভিযান চালালেও ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত জইশ-ই মোহাম্মদ অবাধেই তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছিল। তবে লস্কর-ই জাংভির এক নেতা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

দক্ষিণ পাঞ্জাবের এই জঙ্গিদের সমূলে উৎখাতের জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের কাছে কিছু সুপারিশও রেখেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

কাউকেও বাদ না রেখে সব জঙ্গি সংগঠনগুলোকে এক দৃষ্টিতে দেখে তাদের নির্মূলে অভিযান চালাতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইসলামাবাদ সরকারকে। বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচার ও কাজ বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।

পাকিস্তান সরকার সব ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখে হিন্দুসহ অন্য ধর্মের মানুষের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেবে, সেই প্রত্যাশা করেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

দক্ষিণ পাঞ্জাবের মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার এবং মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে প্রাদেশিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।

সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মতভিন্নতা ভুলে সব রাজনৈতিক দলগুলোতে সোচ্চার হতেও ক্রাইসিস গ্রুপ আহ্বান রেখেছে।