সেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারতের ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ 

ভয়াবহ খরা সামাল দিতে ভারত সরকার তাদের বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যে প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2016, 02:49 PM
Updated : 24 Jan 2019, 09:02 PM

ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতীকে উদ্ধৃত করে সোমবার বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করে খরা কবলিত এলাকায় সরবরাহ করার ওপর এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। 

টানা দুই বছর বর্ষা বিলম্বিত হওয়ায় এবং প্রলম্বিত তাপপ্রবাহে চলতি বছর ভারতের প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ।

১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সরকার গঠনের পর প্রথম আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত। পরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের আমলে পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার কারণে তা এগোয়নি।

২০১২ সালে ভারতের উচ্চ আদালত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মতি দিলে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর বর্তমান বিজেপি সরকার নর্মদা ও শিপ্রা নদীকে খালের মাধ্যমে যুক্ত করার কাজের মধ্য দিয়ে সেই প্রকল্পের উদ্বোধন করে।

বিবিসি লিখেছে, এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টি সংযোগ খালের মাধ্যমে প্রধান নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে খরাপীড়িত অঞ্চলে। এর মধ্যে ১৪টি খাল হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করবে। আর বাকি ১৬টি হবে উপদ্বীপ অঞ্চলে। 

পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা এ প্রকল্পের বিরোধিতায় বলে আসছে, এভাবে নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে তা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, এমনকি ভারতেও বিপর্যয় ডেকে আনবে।

কিন্তু ভারতীয় হাই কোর্ট সবুজ সংকেত দেওয়ায় ২০১২ সালে বাস্তবায়ন শুরু করে ভারত সরকার।

উমা ভারতী বিবিসিকে বলেন, “নদী সংযোগ প্রকল্প আমাদের প্রাইম এজেন্ডা এবং এ বিষয়ে জনগণ আমাদের পক্ষে। দ্রুত এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।”

তিনি জানান, বর্তমানে পাঁচটি খাল খননের কাজ এগিয়ে চলেছে এবং এর মধ্যে  উত্তর ও মধ্য প্রদেশের কেন-বেতওয়া সংযোগ দিয়ে যে কোনো সময় জলপ্রবাহ চালু করা সম্ভব হবে।   

“এরপর আমরা দামান গঙ্গা-পিঞ্জল সংযোগ চালু করতে পারব, সেক্ষেত্রে মুম্বাইয়ের সুপেয় জলের অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে।”

২০১২ সালে হাই কোর্টের রায় পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে এই পাঁচ সংযোগের কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে ভারতের তখনকার পানিসম্পদমন্ত্রী পবণ কুমার বানসাল বলেছিলেন, এই পাঁচ সংযোগে আন্তর্জাতিক কোনো নদী থেকে পানি প্রত্যাহার হবে না।

কিন্তু ১০ লাখ কোটি রুপির এই প্রকল্পের বাকি ২৫টি সংযোগে যে ৩৭টি নদীকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার মতো আন্তর্জাতিক নদীও রয়েছে।

মানচিত্রে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প: গার্ডিয়ান

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি ও শিল্পের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে গেছে। আর এই সঙ্কট পানির অভাবকে নিয়ে গেছে ভয়াবহ পর্যায়ে।

উমা ভারতী বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতেও হয়তো পানির অভাব থাকবে। কিন্তু নদী সংযোগের মাধ্যমে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারব। জনগণ এটা স্বাগত জানাবে, প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে জমি ছাড়তেও আপত্তি করবে না।”

ভারত সরকার বলছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। উৎপাদন করা যাবে ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত দিক দিয়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কোনোভাবেই টেকসই হবে না।

এমনকি ভারত সরকার পরিবেশের ওপর এ প্রকল্পের প্রভাব সঠিকভাবে যাচাই না করেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের। 

সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার ও পিপল এর সদস্য হিমাংশু ঠাক্কারকে উদ্ধৃত করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নদী সংযোগ প্রকল্পের মূল ধারণা হলো- যেখানে পানি প্রবাহ উদ্বৃত্ত, সেখান থেকে খরাপ্রবণ এলাকায় পানি নিয়ে যাওয়া।

“কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা চলছে, তাতে ভবিষ্যতে কোন নদীর কী অবস্থা হবে তা বোঝা সম্ভব নয়। আর কোন নদীতে পানি উদ্বৃত্ত আছে, কোথায় ঘটতি- সে বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাও নেই।”

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী বয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত হয়ে। ২০১৪ সালে মোদী সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে নতুন করে অর্থ বরাদ্দ দিলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিষয়ে ভারতের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়।

ভারতের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু তারা করবে না।