আইএসআই চর গ্রেপ্তার: নতুন সঙ্কটে তৃণমূল

বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের ‘প্রশয়দাতা’ হিসাবে সমালোচিত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবার তাদের গ্রেপ্তার এক ছাত্রনেতার সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন সঙ্কটে পড়েছে।

ভারত প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2015, 12:54 PM
Updated : 30 Nov 2015, 01:26 PM

উত্তর প্রদেশের মিরাট শহর থেকে মোহাম্মদ ইজাজ ওরফে কালাম নামে ‘আইএসআইয়ের এক এজেন্টকে’ গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত পাঁচজন উর্দুভাষীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কলকাতায়।

গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে মোহাম্মদ আশফাক আনসারী নামের তৃণমূল কংগ্রেসের ওই ছাত্রনেতাও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ভারতের নৌযানের নকশা পাকিস্তানে পাচারের অভিযোগ উঠেছে।

আশফাকের বাবা মুহাম্মদ ইরশাদ আনসারী কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডিং ইয়ার্ডের একজন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। তার সহায়তা নিয়েই আশফাক নকশা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

আশফাক দুই মাস আগেও ওই বন্দর এলাকার হরিমোহন ঘোষ কলেজ শাখা তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্য।

তবে ‘মাস্তানির’ অভিযোগ ওঠায় তাকে আগেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিবের দাবি।

দুই বছর আগে হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে আশফাকের বিরুদ্ধে। ওই সংঘর্ষের সময় তাপস চৌধুরী নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা গুলিতে নিহত হন।

এর আগে গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও নিষিদ্ধ স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়ার সহ-সভাপতি আহমেদ হাসান ইমরানকে রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে সমালোচনায় পড়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস।

ইমরানের বিরুদ্ধে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা এবং সারদার অর্থ বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।         

মুহাম্মদ ইরশাদ আনসারী, তার ছেলে আশফাক আনসারী ও আনসারের মামা জাহাঙ্গীর।

ইরশাদের স্বীকারোক্তি

আটক আশফাকের বাবা ইরশাদ জিজ্ঞাসাবাদে ভারত থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

“ইরশাদ স্বীকার করেছেন, তিনি গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে তৈরি করা বিভিন্ন নৌযানের নকশা এবং তথ্য চুরি করতেন। ছেলে আশফাকের মাধ্যমে চুরি করা সেসব নথি ও তথ্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার কথাও তিনি স্বীকার করেছেন।”

বিভিন্ন সময়ে আশফাকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভ্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে বলেও ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “দশবছর আগে করাচিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আইএসআইয়ের সঙ্গে জড়ান ইরশাদ। পরে তিনি শ্যালক জাহাঙ্গীর এবং ছেলে আশফাককেও দলে টানেন।”

এই জাহাঙ্গীরই গ্রেপ্তার পাকিস্তানি গুপ্তচর মোহাম্মদ ইজাজকে ভারতের জাল পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র এবং মোবাইল সিম কার্ডের ব্যবস্থা করে দেন বলে গোয়েন্দাদের তথ্য।

ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি, ইজাজ ২০১৩ সালে নদীপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢোকেন। এক বাংলাদেশি নাগরিক তাকে ভারতে প্রবেশে সহায়তা করেন।

উত্তর প্রদেশ পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের প্রধান সুজিত পাণ্ডে বলেন, “ভারতে পৌঁছে তারা ইরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জাহাঙ্গীর তাদের আশ্রয় ও ভারতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করেন। ইজাজকে এতিম হিসাবে দেখিয়ে বিহারের এক তরুণীর সঙ্গে তার বিয়েও দেন জাহাঙ্গীর।

“এরপর থেকেই ইজাজ উত্তর প্রদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। সেখানে ভিডিওগ্রাফার হিসাবে কাজ করার আড়ালে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।”

ইরশাদের পরিবার রামনগর লেইনের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। ওই এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা শামসুজ্জামান আনসারীর এক ভাতিজা ওই ফ্ল্যাটের মালিক।

ইরশাদ, আশফাক, জাহাঙ্গীর ছাড়াও আইএসআইয়ের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার অন্য দুইজন হলেন- আখতার খান ও জাফর খান।

কলকাতায় গ্রেপ্তার পাঁচজনের কোনো আত্মীয় বাংলাদেশে থাকার তথ্য ভারতীয় গোয়েন্দারা না পেলেও বাংলাদেশে তাদের যাওয়া-আসা ছিল বলে কর্মকর্তাদের দাবি।

তারা বলছেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার ঝামেলা এড়াতেই’ হয়তো তারা বাংলাদেশে ‘কূটনৈতিক পরিচয়ে থাকা আইএসআইয়ের এজেন্টদের’ সঙ্গে দেখা করতেন।

এছাড়া শনিবার দিল্লি পুলিশ একই অভিযোগে বিএসএফের গোয়েন্দা শাখার হেড কনস্টেবল আবদুল রশিদ ও তার এক সহযোগীকে আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে ভারতীয় সেনা চলাচলের তথ্য পাকিস্তানে পাচারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। 

বিরোধী শিবিরের তোপে তৃণমূল

‘দেশ বিরোধীদের’ আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ায় সোমবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস নেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তৃণমূলকে। 

বিধানসভায় সিপিআই(এম) নেতা সূর্য কান্ত মিশ্র বলেন, “যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় রাখতে সহায়ক হবে- এমন তথ্য পেলেই ‘যে কাউকে’ দলে টানছে তৃণমূল।

“তারা দেশবিরোধীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড এবং আইএসআই সংশ্লিষ্টতা পুরোপুরি খতিয়ে দেখা উচিত।”

কংগ্রেস নেতা মানস ভূইয়া বলেন, “ইরশাদের তৃণমূল ও তার ছেলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার খবরে আমরা মর্মাহত।”

পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে তৃণমূলের ‘দেশবিরোধীদের সঙ্গে’ সখ্যতার সব তথ্য প্রকাশের দাবি জানান বিজেপির আইনপ্রণেতা সামিক ভট্টাচার্য্য।

“তাদের মন্ত্রীরা সারদা কেলেঙ্কারিতে জেলে যান, তাদের এমপিরা সারদার অর্থ বাংলাদেশে জামায়াতকে দেন, এখন তাদের কর্মীরা আমাদের নৌযানের নকশা পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এটি একটি দেশবিরোধী দল।”